হকিং এর ঈশ্বর আর আমার মন
স্টিফেন ডব্লিউ. হকিং। বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় বিজ্ঞানী। মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে তার মন্তব্য তাকে পরিচিত করেছে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে। মোটর নিউরন ডিজিজে ভোগা এই বিজ্ঞানীর জগৎ একটা হুইল চেয়ারে আবদ্ধ। কিন্তু তিনি তার চিন্তার জগৎকে ছড়িয়ে দিয়েছেন এই মহাবিশ্বের দূরতম অঞ্চলে, মহাবিশ্বের গভীরতা মাপতে। চমৎকার এবং সহজবোদ্ধভাবে মহাবিশ্বের সূচনা, ব্যপ্তি, পরিণতির মতো কঠিন বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। তিনি মিডিয়ার আলোচনায় আসেন, তার রেকর্ড সংখ্যাক বিক্রীত বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ এর মাধ্যমে। এই বই তাকে আলোচনায় ও সমালোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। এই বইতে তার সবচেয়ে জনপ্রিয় উক্তি ছিল, তিনি ঈশ্বরের মন বুঝার চেষ্টা করছেন। আবারো তিনি উঠে আসেন আলোচনার কেন্দ্রে তার নতুন বই “গ্রান্ড ডিজাইনের” মাধ্যমে। এখানে তিনি বলার চেষ্টা করেছেন, এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে শূন্য থেকে এবং তার জন্য কোন স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। প্রচন্ড তর্ক-বিতর্কের ঝড় ওঠে তার নতুন মন্তব্যে। মানুষকে বাধ্যকরে নতুন করে হকিংকে ভাবতে এবং তার পূর্বের তত্ত্বের ভিত্তিতে নতুন তত্ত্বকে যাচাই করতে। সেই প্রেক্ষিতে এই প্রবদ্ধ। এখানে আমরা দেখার চেষ্টা করবো হকিং এর নতুন তত্ত্বের মূল কথা এবং বিজ্ঞানের চিরন্তন চরিত্রের বিচারে এর গ্রহনযোগ্যতা।
প্রথমেই দেখা যাক, কি বলেছেন হকিং তার নতুন বইতে।
১. Why is there something rather than nothing?
Why do we exist?
Why this particular set of laws and not some other ….
২. Quantum fluctuations lead to the creation of tiny universes out of nothing. A few of these reach a critical size, than expand in an inflationary manner, forming galaxies, stars, and, at least one case, beings like us…
৩. Bodies such as stars or black holes cannot just appear out of nothing, but a whole universe can….
৪. According to M-theory, ours is not the only universe. Instead, M-theory predicts that great many universes were created out of nothing. Their creation does not require the intervention of some supernatural being or God.
৫. ‘It is not necessary to invoke God to light the blue touch paper and set the universe going….
এসব উক্তি প্রমাণ করে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের এবং দর্শনের প্রান্তিক সমস্যা নিয়ে তার বইয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন। তিনি দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে মহাবিশ্বের অন্তগর্ত কোন কিছুই শূণ্য হতে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু মহাবিশ্ব শূণ্য হতে সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। এম-থিওরিকে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের সাথে যুক্ত করে, বেশ শক্তভাবে সমর্থনের মাধ্যমে একাধিক মহাবিশ্বও যে কোন স্রষ্টা ছাড়া এমনিতেই সৃষ্টি হওয়া সম্ভব তাও তিনি প্রমানের চেষ্টা করেছেন।
এবার হকিং এর নিজের বই এবং আরো দু’ একটা প্রসিদ্ধ বইয়ের উক্তি বিবেচনা করা যাক। এ উক্তি সমূহের মাধ্যমে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো যে, যে বিজ্ঞানের নিক্তিতে হকিং স্রষ্টাকে মেপেছেন, সে নিক্তি কতটা আসলে কতটা সঠিক এবং স্রষ্টা সম্পর্কে এর আগে হকিং কি ধারণা পোষণ করতেন।
১. “প্রমিত বিশ্বচিত্র এখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ পর্যবেক্ষণলদ্ধ তথ্যের ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম এবং এর চেয়ে ভালো কোনো বিশ্বচিত্র আমাদের জানা নেই।......নিত্য নতুন ধারনা আসবেই এবং প্রমান মডেলের সংশোধনও আনতে হবে।.......ছায়াপথ এবং তাদের স্তবক ঠিক কিভাবে তৈরি তা সুনির্দিষ্টভাবে আমরা জানি না। কয়েকটি প্রস্তাবিত মডেল রয়েছে এবং প্রত্যেকের রয়েছে নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা।..........বিশ্বের আদি ব্যতিক্রমী বিন্দুতে সব জ্ঞাত ভৌতবিধিগুলি ভেঙ্গে পড়ে। এর একটা সহজ কারণ হচ্ছে: মহাবিস্ফোরণের ‘আগে কি ঘটেছিল’ তার সম্পর্কে কোনো তথ্যই এটি দিতে পারে না”। ( জোত্যি:পদার্থবিজ্ঞান পরিচিতি, ফারসিম মান্নান, পৃষ্ঠা ৮)
এই উক্তির প্রেক্ষিতে আমরা বিশ্বাস করি হকিং এর প্রস্তাব অন্য যে কারো থেকে বেশি গ্রহন যোগ্য কিন্তু শেষ কথা নয়।
২. “আসলে কেবল পর্যবেক্ষন নির্ভর তথ্য থেকে একটি সম্পূর্ণ বোধগম্য চিত্ররুপ খাড়াঁ করা যায় না-অন্তত বিজ্ঞানের একটি বিকশিত শাখার জন্য তো নয়ই।.........যেমন পর্যবেক্ষণলদ্ধ তথ্য থেকে কখনই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং তার প্রত্যক্ষ ফল কঠিনাবস্থার পদার্থবিজ্ঞান সম্ভব হতো না। বিশেষ করে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে অপারেটর ও স্টেট ভেক্টরদের নীতিগতভাবে কখনোই দেখা সম্ভব নয়। এরা কি কেবল গাণিতিক হিসাবের সুবিধার্তে তৈরি, নাকি এদের কোনো ভৌত বাস্তবতা আছে তা নিয়ে এখনো সন্দেহের নিরসন ঘটেনি।..........বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব আজ বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ, পুর্ণ বিকশিত শাখা এবং এ ধরনের বিকশি কাঠামোতে বিস্ময়কর ঘটনা কিঞ্চতৎ কমই ঘটে এবং সেটাই কাম্য”। (ঐ, পৃষ্ঠ ৭)
লক্ষ্য করুন, পর্যবেক্ষনের সীমাবদ্ধতা। এটি বিজ্ঞানের একটি চিরন্তন বিধি। এই বিধির প্রেক্ষিতে হকিং এর নতুন তত্ত্ব, যা বিশ্বসৃষ্টির সময় স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে, তা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. বিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কয়েকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো, স্থিতিবস্থার তত্ত্ব, গোডেল বিশ্ব, নাট বিশ্ব, প্লাজমা বিশ্বচিত্র, ফ্রাকটাল বিশ্ব, কোয়ান্টাম বিশ্ব, এবং ডিজিটাল পদার্থবিজ্ঞানের প্রবক্তা এডুয়ার্ড ফ্রাঙ্ককিন এর ইনফরমেশন বেইস্ড ইউনিভার্স তত্ত্ব। এসব কি গাণিতিক ভাবে প্রমাণিত নয়? তাহলে কেন বাস্তবতার সাপেক্ষে এদের বেশিরভাগকে বাতিল হতে হলো? কে বলবে যে হকিং এর প্রস্তাবও এদের পরিণতি বরণ করবে না?
৪. “........কাজেই যারা বিজ্ঞান চর্চা করে তারা ধরেই নিয়েছে আমরা যখন বিজ্ঞান দিয়ে পুরো প্রকৃতিটাকে বুঝে ফেলব তখন আমরা সবসময় সবকিছু সঠিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবো। যদি কখনো দেখি কোনো-একটা-কিছু ব্যাখ্যা করতে পারছি না তখন বুঝতে হবে এর পিছনের বিজ্ঞানটা তখনো যানা হয়নি, যখন জানা হবে তখন সেটা চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করতে পারব। এক কথায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা বা ভবিষ্যদ্বাণী সবসময়েই নিখুঁত এবং সুনিশ্চত।..........কোয়ান্টাম মেকানিক্স বিজ্ঞানের এই ধারনাটাকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করেছেন যে, প্রকৃতি আসলে কখনোই সবকিছু জানতে দেবে না, সে তার ভেতরের কিছু-কিছু জিনিস মানুষের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখে। মানুষ কখনোই সেটা জানতে পারবে না- সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে এটা কিন্তু বিজ্ঞানের অক্ষমতা বা অসম্পুর্ণতা নয়। এটাই হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীরা একটা পর্যায়ে গিয়ে কখনোই আর জোর গলায় বলবেন না ‘হবে’ তারা মাথা নেড়ে বলেন, ‘হতে পারে’।.........(কোয়ান্টাম মেকানিক্স: মুহম্মদ জাফর ইকবাল, পৃষ্ঠা ১০)।
এই যদি হয় অবস্থা তাহলে কি করে আমরা হকিং এর একটা প্রস্তাবকে চুড়ান্ত ধরে নিবো? আর যখন প্রকৃতিকেই পুরোপুরি জানা সম্ভন নয়, তখন প্রকৃতির স্রষ্টার দাবিদার কোন সত্তাকে কি করে পুরোপুরি জানা সম্ভব হবে? স্রষ্টা যদি কখনোই সেটা তার সৃষ্টিকে জানতে না দেয় তাহলে কি স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করাই একমাত্র যৌক্তিক কাজ?
৫. “ফার্মিওন ( প্রথম প্রজন্ম, দ্বিতীয় প্রজন্ম, তৃতীয় প্রজন্ম) এবং বোজন আর তাদের শ্রেণীবদ্ধ কোয়ার্ক আর লেপটন ব্যবহার করে পদার্থবিজ্ঞানের যে-মডেল দিয়ে প্রকৃতিকে (লেখকের ভাষায় মহাবিশ্ব) ব্যাখ্যা করা হয়, সেটাকে বলা হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল। যে কণাগুলো দেখানো (এখানে উল্লেখ করা হয়েছে) তাদের ভর নির্ধারণ করার জন্য হিগস বোজন নামে আরও একটি বোজনের অস্তিত্ব অনুমান করা হয়েছে- তবে প্রকৃতিতে আসলেই সেটা আছে কি নেই এখনো কেউ যানে না”। ( ঐ, পৃষ্ঠা ৮৫)
দেখুন। মহাবিশ্বের গঠনগত পদার্থসমূহের ভর নির্ণয়ের জন্য নির্ভর করতে হচ্ছে একট কাল্পনিক কণার উপর। তাহলে, যদি বলা হয় এই মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রারম্ভিক অবস্থা জানার জন্য বা ব্যাখ্যা করার জন্য তো তাদের গঠনগত উপাদান সমূহের ভর জানা একান্ত দরকার। আর তার জন্যও নির্ভর করতে হচ্ছে একটা কল্পার উপর তাও প্রমান করা হয়েছে গনিত দিয়ে ! এটা বিজ্ঞানের ব্যর্থতা নয়। এমন সময় আসবে যখন সত্যিই হিগস বোজেনের অস্তিত্ব আমরা জানবো। একই কথা বলা যায় মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রারম্ভে স্রষ্টার উপস্থিতি সম্পর্কেও।
৬. “.........একটি প্রবন্ধে হকিং আশা করেছেন ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আবিষ্কার হলে মানুষ মহাবিশ্বের উপর প্রভুত্ব স্থাপন করতে পারবে। অপরের উপর করতে মানুষ ভালবাসে। এমনকি ভবিষ্যতে প্রভুত্ব করার সম্ভাবনা কিংবা অতীতে প্রভুত্ব করার স্মৃতিও মানুষকে আনন্দ দান করে। কিন্তু কোন জাতি কিংবা গোষ্ঠীর উপর প্রভুত্ব শুরু হয় আগ্রাসন দিয়ে। দিনের পর দিন সেই প্রভুত্ব বজায় রাখতে হলেও প্রয়োজন হয় দৈনন্দিন আগ্রাসন।
অন্য জায়গায় লেখক (হকিং) একাধিক বার বলেছেন, মানুষের আগ্রাসন প্রবৃত্তি প্রোথিত রয়েছে মানুষের জিনে অথাৎ বংশগতিতে এবং এই আগ্রাসন প্রবৃত্তির অস্তিত্বের ফলেই মনুষ্যজাতির অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মানুষে মানুষে দ্বন্ধ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, আগ্রাসন ইত্যাদির বিরুদ্ধে অধ্যাপক হকিং বারবার মতপ্রকাশ করেছেন। তাহলে এই স্ব-বিরোধিতার কারণ কি?” ( কৃষ্ণগহ্বর এবং শিশুমহাবিশ্ব ও অন্যান্য রচনা: স্টিফেন হকিং: ভাষান্তর শত্রুজিৎ দাশগুপ্ত: বাউলমন প্রকাশন, কলকাতা, পৃষ্ঠা: আ)
এই মন্তব্য করেছেন হকিং এর বইয়ের অনুবাদক। তিনি একজন প্রগতীশীল লেখক এবং মুক্তিবুদ্ধির দাবিদার।
৭. “শ্বেতাঙ্গরা দু-তিন শতাব্দি পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করেছে। এই প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা এর আগে দু-তিন শতাব্দী পৃথিবীতে লুন্ঠন এবং নরহত্যা চালিয়েছে। নরহত্যা না বলে গণহত্যা........এই হত্যা কান্ডের কি নামকরণ করা যায়? মহাহত্যা? মহামহাহত্যা?.........এই ব্যাপারে গুরুত্বের দিক দিয়ে শ্বেতাঙ্গেরদের ভিতর ইংরেজ জাতিই সবচাইতে উল্লেখযোগ্য এবং তাদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য উচ্চশ্রেণী। অধ্যাপক হকিং এর আত্মজীবনীমূলক প্রবন্ধে দেখা যায়, তারঁ জন্ম ইংরেজ উচ্চ শ্রেণীতে এবং ঐ শ্রেণীতেই তিনি লালিত।......শ্বেতাঙ্গ উচ্চশ্রেণীর মানুষদের মতো প্রভুত্বের এই আকাঙ্খা কি অধ্যাপক হকিং-এর রক্তেও জন্মসূত্রে প্রোথিত? (ঐ, পৃষ্ঠা: ই)
৮. “...এই বইয়ের প্রবন্ধগুলি লেখা হয়েছে এই বিশ্বাসে যে, মহাবিশ্ব এমন একটি নিয়মে বাঁধা, যে নিয়ম আমরা এখন অংশত বুঝতে পারি এবং অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা সম্পূর্ণ বুঝতে পারবো। হতে পারে এ আশা নেহাৎই মরীচিকা। চরম তত্ত্ব হয়তো কিছুই নেই: থাকলে হয়তো সেটা আমরা খুজেঁ পাব না। কিন্তু মানুষের মন সর্ম্পকে হতাশ হওয়ার চাইতে সম্পূর্ণ বোঝার চেষ্টা করা অনেক ভাল। ( ঐ: স্টিফেন হকিং, পৃষ্ঠা ক)
মহাবিশ্বের নিয়মগুলো আমাদের জন্য বোঝা অনেক সহজ, অন্তত এর সৃষ্টির নিয়মের তুলনায়। কারণ এ নিয়ম গুলো পর্যবেক্ষণের সুযোগ রয়েছে। অথচ এ সম্পর্কে হকিং এর নিজের মন্তব্য লক্ষ্য করুন।
৯. “সীমানাহীনতার প্রস্তাবের মহাবিশ্বের ব্যাপারে ঈশ্বরের ভূমিকা বিষয়ে গভীর তাৎপর্য রয়েছে। এখন সাধারণত মেনে নেয়া হয় সুসংজ্ঞিত বিধি অনুসারে মহাবিশ্ব বিবর্তিত হয়। এই বিধিগুলি ঈশ্বরের আদেশে হয়েছে- এটা হতে পারে। কিন্তু তিনি আর আইনভঙ্গ করার জন্য মহাবিশ্বে হস্তক্ষেপ করেন না। তবে আধুনিক কাল পযর্ন্ত এই বিধিগুলি মহাবিশ্বের আরম্ভের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।............সুতরাং মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থা হবে ঈশ্বরের প্রাথমিক অবস্থা নির্বাচনের ফল।...........যদি সীমানাহীনতার প্রস্থাব নির্ভুল হয় তাহলে কিন্তু পরিস্থিতিটা খুবই পৃথক হবে। সেক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো মহাবিশ্বের আরম্ভেও প্রযোজ্য হবে। সুতরাং ঈশ্বরের প্রাথমিক অবস্থা নির্বাচনের স্বাধীনতা থাকবে। তবে নির্বাচনের খুব বেশি কিছু হয়তো থাকতো না, হয়তো খুব অল্পসংখ্যক বিধি থাকত। সে বিধিগুলো নিজের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমাদের মতো জটিল জীব সৃষ্টির পথিকৃৎ। সেই জীবেরা প্রশ্ন করতে পারে ঈশ্বরের চরিত্র কিরকম”। ( ঐ, পৃষ্ঠা ৯২)
...হয়তো নির্বাচনের জন্য বিধি অনেক, প্রয়োগ করা হয়েছে কেবল সেগুলো যা চুড়ান্ত ভাবে মানুষ সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য অথবা যেটাই নির্বাচন করা হতো সেটার শেষ হতো এমন মানুষ এর সৃষ্টিতে যারা প্রশ্ন করতে পারে ‘ আর কোন বিধি ছিল না?’ আর স্রষ্টার হস্তক্ষেপ এর ব্যপারে বলা যায়, যিনি মহাবিশ্ব বিবর্তনের জন্য সুসংজ্ঞত বিধি দিয়েছেন, তিনিই তাদের রক্ষণাবেক্ষন করছেন।
এটা এখানে স্পষ্ট যে হকিং স্রষ্টা সর্ম্পকে কিছু গঁতবাধা ধারণা পোষণ করেন। এছাড়া তার কথা স্ববিরোধিতা পূর্ণ এবং ‘হয়ত’ তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠত। গ্রান্ড ডিজাইন বইয়ের উক্তিগুলো খেয়াল করুন। একই রকম চটকদার কথার গাথুনি। এটাকি কেবল নিজেকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা নয়?
১০. “যদি অদ্বিতীয় এক কেতা বিধিই থাকে সেটা শুধামাত্র এক কেতা সমীকরণ। সেই সমীকরণগুলিতে প্রাণসঞ্চার করে কে? কে তা থেকে একটা মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে, যে মহাবিশ্ব তারা পরিচালনা করতে পারে? পরম ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব কি এমনই শক্তিশালী যে সে নিজেই নিজের অস্তিত্ব সৃষ্টি করে? যদিও বিজ্ঞান হয়তো মহাবিশ্ব কি করে সৃষ্টি হয়েছে সে সমস্যার সমাধান করতে পারে, কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না: মহাবিশ্ব অস্তিমান হওয়ার ঝামেলা কেন নিয়েছে? আমিও তার উত্তর জানি না”।(ঐ, পৃষ্ঠা ৯২-৯৩)
লক্ষ্য করুন, হকিং বিজ্ঞানে চিরন্তন নিয়ম হতে এখানে বিচ্যুত হননি। সেই নিয়ম হলো, বিজ্ঞান কেবল জবাব দিবে ‘কি করে হলো’ এবং ‘কেন’ হলো সে জবাব বিজ্ঞানের নয়। অধিবিদ্যার। এটা কি প্রকারান্তরে কোন সুপার ইন্টিলিজেন্টের অস্তিত্ব স্বীকার করা নয়? তাহলে সেখানে স্রষ্টাকে বসাতে সমস্যা কোথায়?
১১. “যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎসর্জিতত কণিকাগুলি এমন অঞ্চল হতে আসে, সে সম্পর্কে পর্যবেক্ষকের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত, সেই জন্য...................তিনি শুধু পারেন কতগুলি কণিকা নির্গত হবে তার সম্ভাব্যতা সম্পর্কে ভবিষ্যত বাণী করতে। সেইজন্য মনে হয় আইনস্টাইন যখন বলেছিলেন ‘ঈশ্বর জুয়া খেলেন না’ তখন ভুল হয়েছিল দ্বিগুণ। কৃষ্ণগহ্বর থেকে উৎসর্জিত কণিকাগুলো বিচার করলে মনে হবে ঈশ্বর শুধুমাত্র জুয়া খেলেন তাই নয়, অনেক সময় তিনি জুয়ার ঘুটিঁ গুলো এমন জায়গায় নিক্ষেপ যে সেগুলিকে আর দেখতে পাওয়া যায় না”।(ঐ, পৃষ্ঠা ১০৫) .....এখানে হয়তো হকিং বলতে চেয়েছেন ঈশ্বর মাঝে মাঝেই এমন হস্তক্ষেপ করেন, যা বুঝা একটু কঠিন।
১২. “..........কিন্তু সত্যিই কি আমরা নিজেদের ভাগ্যবিধাতা? আমরা যা করি সবই কি পূর্ব নির্ধারিত? আগেই ভাগ্যে লেখা ছিল? পূর্বনির্ধারিত ভাগ্যের সপক্ষে যুক্তি ছিল- ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং কালের অতীত, সুতরাং কি হতে চলেছে ঈশ্বর সেটা জানেন। কিন্তু তাহলে স্বাধীন ইচ্ছা আমাদের কি করে থাকতে পারে? নিজেদের কৃতকর্মের জন্য আমরা কি দায়ী হতে পারি?...........মনে হয় মহাবিশ্ব এবং তার ভিতরকার সবকিছু কালানুসারে কিভাবে বিকাশলাভ করবে সে সম্পর্কে সুসংজ্ঞত বিধি আছে। যদিও আমরা এই সমস্ত বিধির একেবারে নির্ভূল গঠন আবিষ্কার করতে পারিনি.....মহাবিশ্বের প্রাথমিক নক্সা হয়ত ঈশ্বর বেছে নিয়েছিলেন কিংবা হয়ত সেটাও নির্ধারিত হয়েছিল বিজ্ঞানের বিধিগুলো দিয়ে। ....সবকিছু নির্ধারিত নির্ধারিত হবে বিজ্ঞানের বিধিসম্মত বিবর্তনের দ্বারা। সুতরাং আমরা কি করে আমাদের নিজেদের ভাগ্যবিধাতা হব সেটা বোঝা কঠিন।.........এমন কোনও মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আছে যে তত্ত্ব মহাবিশ্বের সব কিছু নির্ধারন করে- এ কল্পনের কতকগুলি সমস্যা সৃষ্টি করে।.............অথচ একটি সমীকরণ কি করে- আমাদের চারপাশে যে জটিলতা এবং খুটিঁনাটি বিশদ বিস্তার দেখতে পাই তার কারণ দেখাতে পারে?..........এই নিয়তিবাদের কারণ সর্বশক্তিমান ঈশ্বর কিংবা বৈজ্ঞানিক বিধি যাই হোক না কেন, তাতে কিছু পার্থক্য হবে না। সত্যিই সব সময় বলা যেতে পারে বিজ্ঞানের বিধিগুলি ঈশ্বরের ইচ্ছার প্রকাশ।..........সমস্তই যদি কোন মূলগত তত্ত্ব দ্বারা নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে তত্ত্বটি সম্পর্কে আমরা যা বলি সেটাও ওই তত্ত্ব দ্বারাই নির্ধারিত এবং কেন সেগুলি সোজাসুজি ভূল কিংবা অবান্তর না হয়ে সঠিক হবে- এ প্রশ্নে আমার উত্তর ছিল ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের দ্বারস্থ হওয়া। যারাঁ বিশ্বে সবদিক সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নেন শুধুমাত্র তাদেঁরই বেচেঁ থাকা এবং বংশ রক্ষা করার সম্ভাবনা।.............সেই জন্য আমরা এই কার্যকর তত্ত্বটি গ্রহন করতে পারি: মানুষ স্বাধীন নিযুক্তক তবে তারা কর্তব্য নির্বাচন করতে পারে।..........প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল একটা প্রশ্ন: সবকিছুই কি পূর্বনিধারিত? আমার উত্তর ‘হ্যা’.. কিন্তু উত্তরটা ‘না’ হতে পারে কারণ কি পূর্বনির্ধারিত সেটা আমরা কোনদিনই জানতে পারবো না”। (ঐ, পৃষ্ঠা, ১১৭-১২৮)..........একটা কথাই বলা যায়, ধরে নেয়া হয়েছে স্রষ্টা সর্বশক্তিমান এবং কালের অতীত এবং তিনি জানেন কি হতে চলেছে আর মানুষকি করবে। যদি বলা হয় ‘মানুষের স্বাধীন ইচ্ছায় এবং কতর্ব্য নিধারণে স্রষ্টা হস্তক্ষেপ করেন না বলেই তার চলার জন্য পথনির্দেশ এবং কৃতকর্মের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা’.. তাহলে বোধ হয় কোন বিরোধ থাকে না।
১৩. “......আমার গবেষনা যা দেখিয়েছে সেটা হলো মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হয়েছিল সেটা ঈশ্বরের ব্যক্তিগত খেয়াল- এ কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। কিন্তু তবুও আপনার একটা প্রশ্ন থেকে যায়- মহাবিশ্ব অস্তিত্বে ঝামেলা কেন নিল? আপনার পছন্দ হলে আপনি বলতে পারেন এই প্রশ্নর উত্তরই ঈশ্বরের সংজ্ঞা”। (ঐ, পৃষ্ঠা, ১৫৮)
১৪. “...........এই রকম একটা শুরুর সপক্ষে ছিল এই বোধ যে মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য একট “প্রথম কারণ” প্রয়োজন।(মহাবিশ্বের ভিতরে আপনি সব সময়ই একটা ঘটনার ব্যাখ্যা হিসেবে অন্য একটি র্পূবতন ঘটনাকে কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন। কিন্তু মহাবিশ্বের নিজের অ্স্তিত্ব ব্যখ্যা করার একমাত্র উপায় হল তারও একটা শুরু আছে এই অনুমান।)....................তার বদলে তারঁ(অগাস্টিনের) উত্তর ছিল মহাবিশ্বের কাল ঈশ্বরসৃষ্ট। মহাবিশ্বের আরম্ভের আগে কালের অস্তিত্ব ছিল না।..........পরিবর্তনহীন মহাবিশ্বে আরম্ভ এমন একটা জিনিস যা মহাবিশ্ব বর্হিভূত কোনো সত্তা আরোপ করেছে। এই আরম্ভের কোন ভৌত প্রয়োজনীয়তা নেই। কল্পনা করা যেতে পারে আক্ষরিক অর্থে অতীতের যে কোন কালে ঈশ্বর মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। কিম্বা সৃষ্টি করেছেন বৃহৎ বিস্ফোরনের পরে। কিন্তু এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যেন মনে হয় একটা বৃহৎ বিস্ফোরণ হয়েছিল। তবে বৃহৎ বিস্ফোরনের আগে সৃষ্টি হয়েছিল এ রকম অনুমান করা হবে অর্থহীন। প্রসারমান মহাবিশ্ব স্রষ্টাকে অস্বীকার করে না। কিন্তু সম্ভবত কবে তিনি কাজটি করেছেন তার উপর একটা সময়সীমা আরোপ করে”।( কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: স্টিফেন ডব্লু. হকিং: অনুবাদ, শত্রুজিৎ দাস গুপ্ত: বাউলমন প্রকাশন, কলকাতা পৃষ্ঠা ২৯-৩০)
....এখানে ‘সম্ভবত’ কথাটার উপর আরো সম্ভবতের শর্ত আরোপ করা অযৌক্তিক। কারণ, যেখানে আপনি ধরেই নিয়েছেন যে স্রষ্টা সর্বশক্তিমান, তাহলে সময়ের শর্ত তার উপর আরোপ করা কি যৌক্তিক? কারণ অবোধগম্য সময়ের প্রেক্ষিতে এর সূচনা কাল কারও ইচ্ছার উপর নির্ভর করা সম্ভব, যদি সময় তার প্রতি আনুগত্যশীল হয়।
১৫. “....তারা বলবেন ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি ইচ্ছা করলে যেভাবে খুশি মহাবিশ্ব সৃষ্ট করতে পারতেন। তা হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তিনি মহাবিশ্বকে সম্পূর্ণ সাদৃচ্ছিক পদ্ধতিতে বিকশিত করতে পারতেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মহাবিশ্বকে তিনি বেশ নিয়মবদ্ধ রূপে কতগুলি বিশেষ বিধি অনুসারে বিকশিত করেছিলেন। সুতরাং মনে হয় প্রারম্ভিক অবস্থার নিয়ামক বিধির অস্তিত্ব অনুমান করাও একই রকম যুক্তিযুক্ত হবে”।(ঐ, পৃষ্ঠা ৩২)
......মনে করি স্রষ্টা ইচ্ছা করলেন তারঁ হাতে থাকা একাধিক বিধি, যার প্রত্যেকটি আমরা যেমন দেখি ঠিক সেভাবে ব্যখ্যা করা সম্ভব, এর মধ্য হতে ইচ্ছা মতো যে কোন একটি নিলেন। হয়তো সেগুলো বর্তমান বিধির মতো নয়, কিন্তু তখনও কি আমরা প্রশ্ন করতাম না, কেন তিঁনি এ পদ্ধতি নিলেন? তার মানে কি তার ইচ্ছার ব্যাপারে স্বাধীনতা ছিল না? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব শুধু তখন, যখন আমরা স্রষ্টার মন বুঝতে পারবো।
১৬. “......আমাদের এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণ কি? আমরা যদি এ প্রশ্নের উত্তর খুজেঁ পাই তাহলে সেটাই হবে মানবিক যুক্তির চূড়ান্ত জয়- তার কারণ তখন আমরা জানতে পারবো ঈশ্বরের মন”।(ঐ, পৃষ্ঠা ১৭৮)
...........দু’ভাবে দেখা যাক। প্রথমত, বিজ্ঞান কেবল উত্তর দেয় ‘কি ভাবে হলো’ কিন্তু উত্তর দেয় না ‘কেন হলো’.. সুতরাং বিজ্ঞান কখনোই বলতে পারবে না আমাদের অস্তিত্বের কারণ। তাহলে কি স্রষ্টার মন বুঝা হবে না? বস্তুকেন্দ্রিক বিজ্ঞান নির্ভর যুক্তির কি তাহলে পরাজয় হবে? দ্বিতীয়ত, যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে তাদের একটা বৃহৎ অংশ বিশ্বাস করে আমাদের এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের কারণ একান্তই স্রষ্টার ইচ্ছা। এটি মূলত দর্শন কেন্দ্রিক সমস্যা। এর উত্তর দিতে পারে কেবল দর্শন যা সরাসরি জীবন ঘনিষ্ঠ। পদার্থবিজ্ঞান নয়। এই প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্ব পূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে বার বার উকিঁ দিচ্ছে। তা হলো, হকিং কি পদার্থবিদ, না দার্শনিক? হকিংকে আমরা দেখেছি যে, তিনি তার পূর্বেকার বইয়ে দার্শনিকদের ব্যপারে সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং তাদের খুব কটু দৃষ্টিতে দেখেছেন। অথচ তিনি এখন নিজেকে একজন দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠত করার জন্য দর্শন সম্পর্কিত বিষয়ে বেশ মাথা ঘামাচ্ছেন। কেন একজন পদার্থবিদ এব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছেন? আমরা এর জবাব পাবো যদি আমরা হকিং এর মন বুঝতে পারি, এবং এটা মনে হয় সম্ভব।
যাই হোক, আপনাদের হয়ত অনেকেরই মনে আছে, এর আগে ব্রীফ হিস্ট্রি অফ টাইম-এ হকিং বলছিলেন যে ব্ল্যাকহোল থেকে রেডিয়েশন হতে পারে, যেটা দিয়ে ব্ল্যাক হোল ডিটেক্ট করা সম্ভব! এটা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক বিতর্ক হওয়ার বেশ কিছুদিন পর তিনিই ভুল স্বীকার করে বলছেন ব্ল্যাকহোল থেকে রেডিয়েশন হওয়া সম্ভব না। এমনকি কোন নিশ্চয়তা আছে যে তিনি তার নতুন তত্ত্বের ক্ষেত্রেও একই কাজ করবেন না?
হকিং এর ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো স্রষ্টা সম্পর্কিত কিছু শর্তাধীন ধারণা। তিনি স্রষ্টাকে কিছু বিধির অধীনে কল্পনা করতে অভ্যস্ত। যেমন, স্রষ্টাকে অবশ্যই সৃষ্টির জন্য নিয়োজিত আইনের অধীন অবস্থান করতে হবে, এর বাইরে তারঁ যাবার ক্ষমতা নাই। তাকেঁ জড় বস্তুর কাঠামো, সময়, স্থান, মাত্রার বিধির মধ্যেই থাকতে হয়। তিনিও প্রাকৃতিক বিধির মতো পর্যবেক্ষণলদ্ধ, বোধগম্য, প্রকাশ্য কার্য সম্পাদনকারী। তিনি যদিও সৃষ্টির শুরুতে ভূমিকা হয়তো রেখেছেন, কিন্তু এখন তার কোন কাজ নেই।
বাইবেলিয় পরিবেশের অধীন বেড়ে ওঠা কোন মানুষের জন্য স্রষ্টা সর্ম্পকিত এমন ধারণা পোষণ করা সম্ভব। কারণ বিকৃতি বাইবেলকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, সে তার অনুসারীদের কিছু অলীক ধারনা মুখাপেক্ষি করে দেয়।
অথচ স্রষ্টাকে হতে হবে অবশ্যই তার সৃষ্টি হতে ব্যতিক্রম। কারণ এই পার্থক্যই স্রষ্টাকে তারঁ সৃষ্টির উপর কতৃত্বের মর্যাদা দেয়। তার জন্য জড় বস্তুর কাঠামো, সময়, স্থান, মাত্রার বিধি প্রযোজ্য নয়। কারণ এ বিধি সমূহ তার সৃষ্টির পরিচালনার জন্য প্রযোজ্য। অথচ এ কথা সত্য যে তিনি তার বিধানকে এই শর্তসমূহের কাঠামোতেই রুপান্তরের মাধ্যমেই প্রয়োগ করেন। তার অর্থ কি এই যে তাকে তার সৃষ্টির শর্তই মানতে হবে? তাছাড়া এমন একজন স্রষ্টাকে তাঁর সৃষ্টি কেন মানবে যাকে সে পুরোপুরি বুঝতে পারে? স্রষ্টা আমাদের কাছে বোধগম্য নয় বলেই তাঁকে আমরা মানি, সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করি। আর যখন বিশ্বাস করা হয় এই মহাবিশ্ব তিঁনি সৃষ্টি করেছেন, তখন তিনিই তার পরিচালনা করছেন। নইলে এ মহাবিশ্বের সামগ্রিক সামঞ্জস্য বিনষ্ট হবার মতো যথেষ্ট কারণ, উপাদান থাকা সত্ত্বেও তা টিকে আছে এক অমোঘ বিধাণের শাসন মেনে কোন লঙ্ঘন ছাড়া।
বিজ্ঞান এখনো পুরোপুরি সক্ষম নয় যে সে স্রষ্টাকে নিয়ে চ্যলেন্জ করতে পারে। কারন যে সব ভলগার ম্যটেরিয়ালিস্ট সেই প্রাচীন গ্রীক সোফিস্টদের মতো স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে তাদের বোঝা উচিত তারা যে নিক্তি দিয়ে তার স্রষ্টাকে মাপতে চাচ্ছে, সে নিক্তিও তারঁ তৈরি। যার সাপেক্ষে মাপতে চাইছে তাও তার তৈরী। যে শর্তদিয়ে তাকে বাধতেঁ চাইচে, সে শর্তও তার তৈরী। সুতরাং বিজ্ঞানকে এখনো অনেক অপেক্ষা করতে হবে স্রষ্টার সৃষ্টিকে বোঝার জন্য। স্রষ্টাতো অনেক পরে।
সেদিন আমার এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে, জানিস হকিং কতটা সৎ! তিনি বাজিতে হেরে তার একটা পুরনো তত্ত্বকে বাতিল করে দিয়েছেন। তার বদলে নতুন তত্ত্ব দিয়েছেন। আরেক বন্ধু তখন জবাব দিল, আরে সেই জন্যই তার নতুন দেয়া মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কিত তত্ত্ব নিয়ে ভয়ে আছি। আসলে হকিং দেখিয়েছেন মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন নেই। কারণ সেখানে স্রষ্টার উপস্থিতির কোন প্রমান তিনি পান নাই। এটা কোন ল্যাবে কি হাতে-কলমে প্রমাণ করা সম্ভব? সম্ভবত না। আসুন আমরা এমন আরো কিছু তত্ত্ব দেখি, যে গুলো গাণিতিকভাবে, হাতে-কলমে প্রমান করা সম্ভব।
ক. বৃহৎ বিস্ফোরনের জন্য গ্যলিলিওর পড়ন্ত বস্তুর সূত্রের প্রয়োজন নেই।
খ. পড়ন্ত বস্তুর ক্ষেত্রে হকিং রেডিয়েশনের কোন প্রভাব নেই।
গ. হকিং রেডিয়েশনের জন্য নিউটনের তৃতীয় সূত্র প্রয়োজন নেই।
ঘ. নিউটনের তৃতীয় সূত্রের জন্য স্টোকসের সূত্রের প্রয়োজন নেই।
ঙ. স্টোকসের সূত্রের জন্য রামফোর্ড এর সূত্রের প্রয়োজন নেই।
চ. রামফোর্ডের সূত্রের জন্য আপেক্ষিকতার সূত্রের প্রয়োজন নেই।
ছ. আপেক্ষিকতার সূত্রের জন্য হোবলের হাইপোথিসিস প্রয়োজন নেই।
জ. হোবলের প্রমানের জন্য নীলস্ বোরের পরমানু মডেলের প্রয়োজন নেই।
ঝ. বোরের জন্য ডারউইনের তত্ত্বে প্রয়োজন নেই।
ঞ. ডারউইনের জন্য মিলারের তত্ত্ব প্রয়োজন নেই।
ট. মিলারের জন্য গে-লুস্যাকের তত্ত্বের প্রয়োজন নেই।
ঠ. গে-লুস্যাকের জন্য প্রানের আবির্ভাব এর প্রয়োজন নেই।
ড. প্রাণের আবিভার্বের জন্য মানুষের প্রয়োজন নেই।
এভাবে n বারের জন্য দেখানো যাবে যে হকিং এর তত্ত্বের উপর বিশ্বাস স্থাপনের জন্য কোন যুক্তির প্রয়োজন নেই। আর প্রতিবারেই যাদের প্রয়োজন নেই, তাদেরকে অনুপস্থিত বা তারা নাই প্রমান করা সম্ভব। যুক্তি, গণিত এবং নির্ভূল পরীক্ষার মাধ্যমে। অনেকেই বলবেন যে এটা স্রেফ সার্কাজম। আমরা একমত যে একজন বিজ্ঞানী যদি তার বইয়ের কাটতি বাড়ানোর জন্য সার্কাজমের আশ্রয় নিতে পারে, তাহলে আমাদের অপরাধ কোথায়? আইনস্টাইন একটা কথা বলেছিলেন, “তোমার মস্তিস্কের ব্যস কি ২০,০০০০ আলোক বর্ষ? যদি না হয় তবে তুমি স্রষ্টা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন করার অধিকার রাখো না”.. অনেকে হকিংকে আইনস্টাইনের পরে বিবেচনা করতে পছন্দ করে। এটা আদৌ যুক্তি সঙ্গত কিনা প্রশ্ন করা স্বাভাবিক।
বিজ্ঞান এগিয়ে চলে দ্বন্ধ, প্রতিদ্বন্ধ এবং তাদের সমাধানের মাধ্যমে। বিজ্ঞান মনস্ক মনে প্রশ্ন ওঠে, সে তার সমাধান খোঁজে, এবং এক সময় আবিষ্কার করে ঘটনা এবং তার পেছনের তত্ত্বকে। এক তত্ত্ব চ্যলেন্জ করে আরেক তত্ত্বকে। এভাবে এক সময় প্রতিষ্ঠা পায় চুড়ান্ত তত্ত্ব। কিন্তু এটিই শেষ কথা নয়। আগীমাকালের নতুন কোন প্রতিপাদন হয়তো আজকের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে ভেঙ্গে দিয়ে গড়ে দেবে নতুন কোন সত্যকে।
হকিং এর প্রতিপাদনের অনুমানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু প্রশ্ন রয়েছে যারা এখনো অমিমাংসিত। যেমন, মহাবিশ্বে কি এমন কোন ঘটনা কেউ প্রত্যক্ষ করেছে যা স্বত:স্ফুর্তভাবে ঘটছে বা ঘটেছে (কার্যকারণ ছাড়া এবং গণিতের সাধারণ বিন্যাসের নিয়ম মেনে), যার ফলে নতুন কোন বস্তু তৈরী হচ্ছে, একে বারে শূণ্য হতে?(লক্ষ করুন, এটি কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বা রেডিয়েশন নয়। কারণ এসব এক মৌল হতে আরেক মৌলের রুপান্তর উদাহরণ)
মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রারম্ভে যে নীতি গুলো দায়ী ছিল সে সব নীতির উৎপত্তি হলো কোথা হতে? তাহলে কি কেউ পূর্বেই শূণ্য হতে মহাবিশ্ব তৈরীর নীতি সমূহ তৈরী করে রেখেছিল? তাছাড়া সে সময়ের বিধি গুলো কিভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিবর্তিত হলো যা একটি সুশৃঙ্খল বিশ্বের গঠনে ভূমিকা রাখলো? কেন সে বিবর্তিত বিধি গুলো আরো বিবর্তিত হয়ে নতুন মহাবিশ্ব তৈরী, অথবা এই মহাবিশ্বের ধ্বংস, অথবা অন্য কোন ঘটনার জন্য স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হচ্ছে না। কেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি হতে এখন পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র গুলো এমনভাবে প্রয়োগ হলো যা প্রাণ ধারণের উপযোগী একটি মাত্র গ্রহের জন্ম দিল এবং তাকে চলনক্ষম রাখার জন্য সকল নিয়ামককে নিয়োজিত করলো? আমাদের চারপাশে জীবন ধ্বংস করার মতো হাজারো, লক্ষ উপাদান থাকার পরেও কেন তাদের থোরাই কেয়ার করে জীবন টিকে আছে পরম নিশ্চিন্তে? কোন সে বিধান পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশকে নিশ্চিত করেছে অনিশ্চয়তার মহাগহ্বরের মাঝে?
আমরা হয়তো এখনি এসব সমস্যার সমাধান জানতে পারি নি। হয়তো হকিং এর চির কাঙ্খিত মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব আমাদের এসব জীবন ঘনিষ্ঠ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে, হয়তো পারবে না। কিন্তু তাই বলে কি স্রষ্টার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে? না। হয়তো আমরা তাকেঁ কখনই খুঁজে পাবো না। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি, তাঁর নিদর্শন তাঁর অস্তিত্ব ঘোষনা করে যাবে পরম নিশ্চয়তায় অনাদি হতে অনন্তকাল পর্যন্ত।
আহমাদ ইসমাঈল হোসেন
প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ,
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।
তথ্য সূত্র:
১. গ্রান্ড ডিজাইন, স্টিফেন হকিং
২. কৃষ্ণ গহ্ববর ও শিশু মহাবিশ্ব, স্টিফেন হকিং
৩. কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, স্টিফেন হকিং
৪. জ্যোতি:পদার্থবিজ্ঞান পরিচিতি, ফারসিম মান্নান মোহাম্মদ
৫. কোয়ান্টাম মেকানিক্স, মুহম্মদ জাফর ইকবাল
৬. আল কোরআন দ্যা চ্যালেন্জ, (খন্ড ১,২) কাজী জাহান মিঁয়া
৭. স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব, মাওলানা আব্দুর রহীম
৮. নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, আহমেদ হোসাইন
৯. উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞান, শাহজাহান তপন
১০. ইন্টারনেট
Comments
Post a Comment