জার্নি টু ভাইরাস: পর্ব ০২


ভাইরাস কিন্তু কোন ইংরেজি শব্দ নয়। এটি একটি ল্যাটিন শব্দ এসেছে ল্যাটিন ভাষা হতে। ল্যাটিন ভাষা অনেক পুরাতন একটি ভাষা। প্রাচীন রোম এবং ল্যাটিয়ানরা এ ভাষা ব্যবহার করতো। তোমরা তো জান আমাদের বিজ্ঞানের অনেক অনেক শব্দ এসেছে ল্যাটিন ভাষা হতে। ল্যাটিন ভাষায় ‘ভাইরাস’ মানে হলো ‘বিষাক্ত তরল’... নাম থেকেই তো বোঝা যাচ্ছে যে এরা আসলে খুব সুবিধার জিনিস না। যাই হোক। আমরা যেহেতু ভাইরাসের রাজ্যে আমাদের যাত্রা শুরু করেছি তাই প্রথমেই আমরা জানবো কিভাবে এই ভাইরাস আবিস্কার হলো।

পুরো রুমের সবাই একেবারে চুপ। এটা হচ্ছে পরের দিনের কথা। ডাক্তার আংকেল তার কথা মত পরের দিন রাহাতকে দেখতে এলেন। রাহাত এবং সাইমুম তাদের আরো কয়েকজন বন্ধুকে তাদের জার্নি টু ভাইরাসের কথা বলেছে। ওরা তো শুনে একপায়ে দাঁড়িয়ে গেলো এটা শোনার জন্য। আসলে কেউ কিন্তু একপায়ে দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু রাহাত আর সাইমুমের কাছে ভাইরাসের গল্প শুনে ওরাও শোনার জন্য এতোটা আগ্রহী হলো যে তক্ষুনী তক্ষুনী সবাই দাঁড়িয়ে গেলো। কথা মত পরের দিন তালহা, জুবায়ের, ফারদিন, জাওয়াদ, মুজাহিদ, ফিরোজ, হাসিব এক্কেবারে সময়মত রাহাতদের বাসায় চলে এলো। রাহাততো খুব অবাক। ওরা কখনো সময়মত ঘুম থেকে ওঠে, খাবার খায়, হোমওয়ার্ক করে কেউ কোনদিন শোনেনি। কিন্তু গল্প শোনার জন্য এক্কেবারে ঠিক সময়ে চলে এলো কি করে? কি জানি, ওরাও বোধহয় ওর মত গল্পশুনতে অস্থির হয়ে আছে।

-তোমাদের আগেই বলে দিচ্ছি। কেউ যদি কিছু বুঝতে না পারো তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন করবে। কেউ যদি লজ্জা পেয়ে প্রশ্ন না করো, তবে কিন্তু নিজেই ঠকবে। সেই জিনিসটা আর জানা হবে না।
-আংকেল যে কি বলো। আমরা কি মেয়ে যে লজ্জা পাবো?
-লজ্জা পাবার জন্য মেয়ে হতে হয় না। জানো আংকেল, ও ক্লাসে কিছু না বুঝলে স্যারকে জিজ্ঞেস করে না। ওর নাকি লজ্জা লাগে।
-এভাবে সবার সামনে হাটে হাঁড়িটা না ভাঙ্গলেও পারতি।
-আরে রাখো রাখো। ঝগড়া করলে ‘জার্নি’ হবে কি করে? শোনো। যারা কিছু জানতে চায় তারাই প্রশ্ন করে। তোমরা কি জানো, যারা বুদ্ধিমান তারা প্রশ্ন করে আর যারা বোকা তারা তর্ক করে। মানে না বুঝেই ঝগড়া করে। আর যারা বিজ্ঞানী, তারাতো সব সময় প্রশ্ন করতেন। সব বিষয়ে তারা জানতে চাইতেন। আর সে জন্য যাকে পেতেন তাকেই প্রশ্ন করতেন।
-আমার মত। আমিও অনেক প্রশ্ন করি।
-হ্যাঁ করিস। বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন শুনলে মনে হয় উত্তর দেই। আর তোরটা শুনলে মনে হয় তুলে.......
-কি যেনো বলছিলাম? ও হ্যা। শোনো। তোমরা তো ফ্রান্সের বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর এর কথা শুনেছো। যিনি সর্বপ্রথম ‘র‍্যাবিস’ এবং ‘এনথ্রাক্স’ রোগের প্রতিষেধক আবিস্কার করেছিলেন। এর ফলে হাজার হাজার মানুষ ‘র‍্যবিস’ এবং ‘এনথ্রাক্স’ রোগে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। এই রোগগুলো কিন্তু ভাইরাসের আক্রমনের কারণে হয়। মজার ব্যপার হলো, লুই পাস্তুর এদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রতিষেধক আবিস্কার করেন, কিন্তু তিনি তখনো জানতেন না যে এই রোগগুলো কেন হয়। আরো অনেক পরের ঘটনা। ১৮৯২ সালে রাশিয়ার উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দিমিত্রি ইভানোভস্কি তামাক গাছের মোজাইক রোগের উপর গবেষনা করছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন তামাক গাছের মোজাইক রোগ ব্যকটেরিয়ার জন্য হয়। আসলে কিন্তু তা নয়। এটার জন্য অন্য কিছু দায়ী।
- আচ্ছা আংকেল, তামাক গাছের মোজাইক রোগটা কি?
- তামাক গাছের মোজাইক রোগটা হলো, তামাক গাছের পাতায় মোজাইকের মত ছোটো ছোটো ছাঁপ বা স্পট পড়ে যায়। আর এটা হয় ‘টোবাকো মোজাইক ভাইরাসে’র জন্য। তামাককে ইংরেজিতে টোবাকো বলে। যাই হোক। তামাক গাছের মোজাইক রোগের জন্য যে ভাইরাস দায়ী এটা কিন্তু তখনো বিজ্ঞানী দিমিত্রি ইভানোভস্কি জানতেন না। তিনি করলেন কি, একটা বিশেষ ধরনের ছাঁকনি ব্যবহার করলেন। এই ছাঁকনির নাম হলো ‘চেম্বারল্যান্ড ফিল্টার’.. ফ্রান্সের বিজ্ঞানী চার্লস চেম্বারল্যান্ড ১৮৮৪ সালে এই বিশেষ ছাঁকনি আবিস্কার করেন। এর ছিদ্রগুলো এতোটাই ছোটো যে ব্যকটেরিয়া পর্যন্ত এতে বেঁধে যায়। ভেবে দেখো তো, ব্যাকটেরিয়ার মত ক্ষুদ্র জিনিস যাকে কিনা দেখার জন্য অনুবীক্ষণ যন্ত্র দরকার হয়, সেই ব্যকটেরিয়া পযর্ন্ত এতে বেধে যায়। এর মধ্যে দিয়ে কেবল ব্যকটেরিয়ার চেয়ে ছোট জিনিসই ছাঁকা যায়। দিমিত্রি ইভানোভস্কি করলেন কি, মোজাইক রোগে আক্রান্ত তামাক গাছের পাতার রস নিয়ে চেম্বারল্যান্ড ফিল্টার দিয়ে ছাঁকলেন। এখন তোমরা বল, ছাঁকার পরে যে অবশিষ্ট অংশগুলো থাকবে, সেখানে কি থাকবে?
-অবশ্যই ভাইরাস।
-ঠিক। কিন্তু তখনো তো ভাইরাস আবিস্কার হয়নি। তাই তিনি জানতেন না যে এখানে ভাইরাস রয়েছে। তিনি করলেন কি, সেই অবশিষ্ট অংশগুলো একটা সুস্থ গাছের মধ্যে দিলেন। এবং কিছুদিন পরে সেই গাছের মধ্যেও মোজাইক রোগ হলো। এতে করে তিনি বুঝলেন, এই রোগের জন্য আর যাই হোক, ব্যাকটেরিয়া দায়ী নয়। কারণ ব্যাকটেরিয়া তো ছাঁকনিতে আটকে গিয়েছিলো। তখন তিনি বললেন, ব্যাকটেরিয়া থেকে একধরণের ‘বিষ’ বের হয় যার কারনে এই রোগ হয়। পরে ১৮৯৮ সালে নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানী ‘মার্টিনাস বেইরিঙ্ক’ একই পরীক্ষা আবারো করেন এবং বলেন যে এই রোগের জন্য অন্য একধরণের জীবানু দায়ী। পরবর্তীতে তিনিই এটির নামকরণ করেন ভাইরাস। তোমাদের তো বলেছি, ভাইরাস ল্যাটিন শব্দ এবং এর মানে ‘বিষাক্ত তরল’. বিজ্ঞানী বেইরিঙ্ক মনে করেছিলেন এই ভাইরাস বা জীবানুগুলো একধরণের তরল। সেই জন্য তিনি এগুলোর নাম দেন ভাইরাস। পরে অবশ্য আবিস্কার হয় যে ভাইরাস তরল নয়, একধরণের বস্তু।
-ওহ্। জটিল জিনিস তো।
-অবশ্যই জটিল। তোমাদের যখন এদের গঠন, মানে কি দিয়ে, কিভাবে এরা গঠিত, কিভাবে এদের জন্ম আর মৃত্যু হয়, এসব বলবো তখন বুঝতে পারবে আসলেই এরা কতটা জটিল। তবে আজকে আর নয়। আজকের মত আমাদের জার্নির বিরতি। 

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account