ডারপার গল্প


অক্টোবর ৪, ১৯৫৭. ঘড়ির কাটায় সময় ১৯ টা বেজে ২৮ মিনিট। সোভিয়েত ইউনিয়নের তুরানতামে জড় হয়েছে বেশ কিছু উৎসাহী মানুষ। উৎকন্ঠার সাথে ঘড়ির কাটা গুনছে। আর রেডিওতে কান পেতে আছে পুরো জাতি। থাকবেনা কেন? এ যে পুরো জাতির সম্মান আর মর্যাদার প্রশ্ন। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। পুরো স্পেস সেন্টার জুড়ে আলোর স্ফূলিঙ্গ ছুটে গেলো। মাটির বুক ছেড়ে শূণ্যে যাত্রা শুরু করলো স্পূটনিক-১. সেকি আবেগ আর আনন্দের বন্যা। এবার বুজি সোভিয়েতদের আকাশ জয়ের স্বপ্নও বাস্তব হতে চললো। হোকনা স্পুটনিক-১ কেবল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণকারী একটি আবহাওয়া স্যাটেলাইট, তাতে কি। আকাশের বুকে তো তারাই প্রথম স্বগর্বে তাদের উপস্থিতি ঘোষনা করলো। ভদকার স্রোতে ভেসে গেলো স্টালিনগ্র্রাদ। উল্লাসে ফেটে পড়লো সোভিয়েতরা। কিন্তু ঠিক বিপরীত চিত্র আটলান্টিকের অপর পাড়ে। স্নায়ূ-যুদ্ধের আরেক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র স্পূটনিক-১ এর আকাশ ভ্রমনকে নিলো ঠিক উল্টোভাবে। স্পূটনিক-১ এর উর্ধ্বগমন যুক্তরাষ্ট্রকে যেন নিম্নে  পাঠিয়ে দিল। এবার বুজি আকাশে তাদের প্রতিপক্ষ তাদের জন্য শক্ত চ্যালেন্জ হয়ে দাড়ালো। আসলে এটি ছিল সোভিয়েত এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের জন্য মর্যাদার প্রশ্ন। আর তাতে এগিয়ে গেলো সোভিয়েতরা। যুক্তরাষ্ট্র তার শীর্ষ নীতি-নির্ধারকদের এর সমাধানের জন্য আহ্বাণ করলো। তারা সিদ্ধান্ত নিল, প্রযুক্তির মোকাবেলা হবে প্রযুক্তি দিয়ে। গঠন হলো ডারপা (DARPA) “Defense Advanced Research Projects Agency”. সময়টা ছিল ১৯৫৮. এ ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কারণ এই এজেন্সি যুক্তরাষ্ট্রকে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বই দান করেনি, করেছে একক পরাশক্তি হিসেবে তার অবস্থানকে শক্ত করার জন্য অত্যাধুনিক সব যুদ্ধাস্ত্র। এই এজেন্সি বেসামরিক খাতে যথেষ্ঠ গবেষণা করলেও এটি মূলক একটি সামরিক গবেষণা সংস্হা। তারা তাদের কার্যক্রম ১৯৫৮-১৯৬৫ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে শুধুমাত্র মহাকাশ গবেষনা, ব্যালাস্টিক মিসাইল প্রতিরোধ এবং নিউক্লিয়ার টেস্ট ডিটেকশনের মধ্যে। পরবর্তীতে তারা তাদের বেসামরিক মহাকাশ গবেষণা “ National Aeronautics and Space Administration (NASA)” কে হস্তান্তর করে। তারা মনোযোগী হয় “ডিফেন্ডার ( ব্যালাস্টিক মিসাইল প্রতিরোধ ব্যাবস্হা)”, প্রজেক্ট ভেলা (নিউক্লিয়ার টেস্ট ডিটেকশন), প্রজেক্ট এগাইলি এবং এই সময়ের মধ্যই তারা শুরু করে কম্পিউটার প্রসেসিং, প্রাণীর আচরণ বিদ্যা এবং কণা-বিজ্ঞানের উপর গবেষণা। মূলক প্রজক্ট ভেলা এবং এগাইলি তাদেরকে রাডার, ইনফ্রারেড সেন্সিং ও এক্স-রে/গামা রে নির্ধারণ এর উপর প্রভূত বুৎপত্তি অর্জননে সাহায্য করে। ১৯৭০ এর সময় তারা তাদের গবেষণা সম্প্রসারণ করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ, এনার্জি প্রজেক্ট এবং টেকটিক্যাল প্রযুক্তির দিকে।
“ডারপা” তাদের প্রাথমিক অগ্রগতি লাভ করে তথ্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে। এটি ছিল একটি ‘টাইম-শেয়ারিং’ প্রকল্প যা তারা ‘বেল ল্যাব’, ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’ এবং ‘এমআইটি’এর সাথে যৌথভাবে সম্পন্ন করে। তারা তাদের অগ্রগতির দ্বিতীয় পর্যায়ে উপহার দেয় কিছু যুগান্তকারী আবিষ্কার। এগুলোর মধ্যে ARPANET, Packet Radio network, Packet satellite network, Artificial Intelligence of speech recognition, Signal processing , এবং Internet. উল্লেখ্যযোগ্য।

এতসব কিছুর সাথে যুদ্ধাস্ত্রের উদ্ভাবন এর ক্ষেত্রেও ডারপার অবদান কোন অংশে কম নয়। তাদের উদ্ভাবিত কিছু যুদ্ধাস্ত্রের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ্য করার মতো হল, ‘স্টিলথ জঙ্গি বিমান’, ‘এম১৬ এসল্ট রাইফেল’ সহ আরো অনেক প্রকাশ্য ও গোপন অস্ত্র।

ডারপার গবেষণার ক্ষেত্র যথেষ্ট বিস্তৃতি লাভ করেছে এই কয়েক বছরে। তারা কণা-পদার্থ বিজ্ঞান থেকে শুরু করে টেলিপ্যাথি পর্যন্ত তাদের কাজ ছড়িয়ে দিয়েছে। তাদের কাজের পরিধি দেখার জন্য আমরা এখন তাদের চলমান এবং ভবিষ্যত কাজের তালিকায় আছে এমন কিছু প্রকল্প দেখবো।

১. Silent Talk 'Telepathy' For Soldiers: ভাবুনতো যুদ্ধ চলছে, অথচ সৈন্যদের মধ্যে কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। হচ্ছে না মানে দেখা যাচ্ছে না। যাবে কি করে? তারা তো প্রচলিত কোন ওয়াকিটকি বা যন্ত্র ব্যাবহার করছে না। তারা তাদের মস্তিস্কে লাগানো ছোট্ট ডিভাইসের মাধ্যমে একজন আরেক জনের সাথে যোগাযোগ করছে। মানে একজনের চিন্তা বা নির্দেশনা সে কোন মাধ্যম ছাড়াই পাঠিয়ে দিচ্ছে অন্যজনের কাছে। আর এমন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছে ডারপা। তারা আমেরিকান সৈন্যদের জন্য এ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে।

২. TASC - DARPA's Psychohistory : এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন হলে আগে থেকেই সামরিক বাহিনী বা সরকার বৃহৎ জনগণের চিন্তা-ভাবনা ধারণা করতে পারবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।

৩. Guided Bullets By Exacto  : এক সময় প্রচলিত ছিল যে বন্দুক থেকে গুলি বের হয়ে গেলে তাকে আর ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু ডারপা বোধ হয় এ প্রবাদ কে মিথ্যা প্রমাণ করতে যাচ্ছে। তাদের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এমন সব বুলেট পাওয়া যাবে যারা তাদের লক্ষ্যের স্হান পরিবর্তনের সাথে সাথে নিজেদের গতি পথও পরিবর্তন করতে পারবে।

৪. Self-Repairing Hunter-Killers: এই গবেষণার লক্ষ্য হলো এমন সব রোবট উদ্ভাবন যারা বায়ূর মধ্য দিয়ে চলবে এবং শত্রু পক্ষের আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্থ অংশ ফেলে দিয়ে হলেও শেষ পর্যন্ত মিশন সম্পন্ন করবে।

৫. DARPA Gandalf Project : যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু পক্ষের ব্যবহৃত টেলিফোন এর সাহায্যে তাদের অবস্থান নিখুঁত এবং পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে নির্ণয় করা যাবে এ প্রযুক্তিতে।

৬. EATR - DARPA's Energetically Autonomous Tactical Robot : এ গবেষণার ফলে এমন সব রোবট উদ্ভাবিত হবে যারা দীর্ঘস্থায়ী মিশন সম্পন্ন করতে পারবে। এদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হবে যে এরা প্রয়োজনে নিজেদের জ্বালানি নিজেরাই সংগ্রহ করে নিতে পারবে।

৭. Harnessing Infrastructure for Building Reconnaissance (HIBR): দূর থেকে যে কোন কাঠামোর সম্পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এমনকি এটি যদি মাটির নিচেও হয় তবুও তার অভ্যন্তরের পূর্ণ চিত্র পাওয়া সম্ভব।

৮. Katana Mono-Wing Rotorcraft Nano Air Vehicle: শুধু মাত্র একটি রোটর বিশিষ্ট এবং একটি কয়েনের আকারের এই হেলিকপ্টারটি সামরিক ব্যবহারের জন্য বিশেষ করে গোয়েন্দাবৃত্তির জন্য তৈরী করা হচ্ছে।

৯. Aqua Sciences Water From Atmospheric Moisture: এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো খুবই অল্প পরিমাণ শক্তি ব্যয় করে বাতাসের আদ্রতা হতে পানি উৎপন্ন করা।
১০. Shape-Shifting Bomber In Need Of Plowsharing : এই জাতীয় বোমারু বিমান গুলো তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী আকৃতি পরিবর্তন করে নিতে পারবে।

১১. Automated Mammalian Training Devices: আপনার কুকুরকে প্রশিক্ষন দিয়ে যুদ্ধে বা অপরাদ দমনে ব্যবহার করতে চান? তাহলে কোন প্রশিক্ষক খোঁজা বাদ দিয়ে অপেক্ষা করুন এই ডিভাইসের জন্য। এটি মানুষের পরিবর্তে মানুষের মত করেই যে কোন প্রাণীকে প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম। ক
১২. Transformer (TX) Vehicle AKA flying car  কমপক্ষে চারজন যাত্রী বহনে সক্ষম এই যান সহজেই আকাশে উড়তে পারবে এবং ল্যান্ড করতে পারবে। এককথায় উড়ন্ত মোটর গাড়ীও বলা যায় এটিকে।
১৩. JOULE AKA Ten times Higher Density Batteries : অত্যন্ত উচ্চক্ষমতার চার্জ ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই ব্যাটারি সাধারণভাবে ব্যবহৃত লিথিয়াম ব্যাটারির চেয়ে কমপক্ষে দশগুণ বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন। রিচার্জেবল এই ব্যাটারির গবেষণায় ডারপা খরচ করছে প্রায় ৪ মিলিয়ন ডলার।
১৪. Blood Pharmingসারা পৃথিবী জুড়ে রক্ত দান একটি মহৎকাজ বিবেচিত হলেও, সময়মত ও প্রয়োজন মত বিশুদ্ধ রক্ত পাওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে দাড়ায়। ডারপা তাদের এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে গবেষণাগারে প্রোজেনিটর কোষ হতে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত তৈরী করবে যা হাজারো মুমূর্ষ রোগীকে বাচাঁতে অবদান রাখবে।
১৫. Reliable Neural-Interface Technology (RE-NET)বে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোন মানুষের নিউরনে সঞ্চিত তথ্য অনায়াসে বের করে নেয়া যাবে।

এরকম শত শত প্রকল্প ডারপা প্রতি বছর পরিচালনা করে। সারা পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরা দিন-রাত কাজ করে চলেছেন তাদের গবেষণাগারে। উদ্দেশ্য একটাই। নতুন কিছু উদ্ভাবন যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পৃথিবীর একক পরাশক্তি হতে সহায়তা করবে। আর তাদের জন্য মার্কিন সরকার প্রতি বছর একটা বিরাট অংকের বাজেট বরাদ্দ করে। সর্বশেষ পাশকৃত বাজেট ৩.২ বিলিয়ন ডলার। বেশ বড় অংকের বাজটে বৈকি! তবে যতযাই বলি, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির মহাসড়ক নির্মানে ডারপার অবদান কিন্তু কোন অংশেই কম নয়। আর সবশেষ পাঠকদের কাছে একটা প্রশ্ন ছেড়ে দিচ্ছি, আমরা কি পারি না, ডারপার মত না হলেও, ছোট হলেও এমন একটা গবেষণা সংস্থা গড়ে তুলতে, যা বাংলাদেশকে তথ্য-প্রযুক্তিতে সামনের কাতারে নিয়ে দাঁড় করাবে?

লেখক: আহমাদ ইসমাঈল হোসেন
শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ।
তেজঁগাও কলেজ, ঢাকা।


তথ্যসূত্র:
১. http://en.wikipedia.org/wiki/DARPA
২. http://www.darpa.mil/
৩. http://www.defense.gov/
৪. http://www.technovelgy.com/ct/Technology-Article.asp?ArtNum=59
৫. www.darpa.org

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account