মানুষকে দেখানোর জন্যই আমরা দেনমোহর নির্ধারণ করি

মেয়েটিকে নিয়ে ছেলেটি তার বন্ধুর বাসায় পালিয়ে এসেছে বিয়ে করার জন্য। দীর্ঘদিনের প্রেম অথচ পরিবার এই বিয়েতে রাজি নয়। তাই এই সিদ্ধান্ত। বিয়ের আয়োজন তাৎক্ষণিকভাবে যা করা সম্ভব তাই করা হয়েছে। যথাসময়ে কাজী উপস্থিত। ছেলের বন্ধুরাও অনেকে আছে। বিয়ে পড়ানো শুরু হতেই মেয়েটি হঠাৎ বেঁকে বসলো। দেনমোহর ২০,০০,০০০/- (বিশ লক্ষ) বা তার বেশি না হলে সে বিয়ে করবে না। মেয়েটির এমন আচরণে অন্যরা বেশ বিরক্তই হলো। এটা কেমন কথা? এতোদিন রিলেশন করে পালিয়ে এসেছে বিয়ে করার জন্য। এমন সময় এমন আজব গোঁ ধরার মানে কি? তাছাড়া এতোগুলো টাকা কি মুখের কথা নাকি?

অন্যদিকে ছেলেটি মেয়েটির কথা শুনে সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে কাজীকে বল্লো, দেনমোহর ৫০,০০০,০০/- (পঞ্চাশ লক্ষ টাকা!!!), আপনি বিয়ে পড়ান।

শুনে কি মনে হচ্ছে? ছেলে বিরাট কোটিপতি? জ্বি না। এককালে তার বেশ ভালো ব্যবসা বাণিজ্য থাকলেও বর্তমানে বেকার। বাসা ভাড়া দিতেও কষ্ট হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এতোদিন সম্পর্ক করে বিয়ের সময় মেয়েটি এমন দাবী কেনো করলো আর ছেলেটিই বা এমন আজব অংকের টাকা কেনো প্রস্তাব করলো।

একটু চিন্তা করলেই উত্তরটা পাওয়া যাবে। পুরো ব্যাপারটায় মেয়েটি এবং ছেলেটি- উভয়ই তাদের প্রেস্টিজ নিয়ে টেনশিত ছিলো। মেয়েটির চিন্তা ছিলো অল্প দেনমোহরে বিয়ে হলে মানুষের কাছে মুখ দেখাবো কিভাবে। আর ছেলেটি চিন্তা করেছে বিরাট অংকের টাকা দেনমোহর হলে মানুষের কাছে ভাব-সাবই অন্যরকম হবে।

বিশ্বাস করুণ, মেয়েটি ভালো করেই জানে জীবনেও সে এই টাকা পাবে না যতক্ষণ না সে ছেলেটিকে ডিভোর্স দিয়ে থানা-আদালত করে এই টাকা আদায় করে। আবার ছেলেটিও জানে এটা স্রেফ খাতা-কলমে থাকার বিষয় এবং মুখে বলার বিষয়- জীবনেও সে এই টাকা পরিশোধ করবে না। 

এটাতো পালানো বিয়ের ঘটনা। পারিবারিকভাবে ঠিক করা বিয়েতে ঘটনাতো আরো জটিল।

দেনমোহর বিয়েতে একটি মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা ছেলেটিকে অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। দেনমোহর পরিশোধ না করলে বা পরিশোধের ওয়াদা না থাকলে বিয়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকে। দেনমোহর এমনভাবে ধার্য করা উচিত যা ছেলেটি সহজেই আদায় করতে পারে।

আমাদের সমাজে দেনমোহর নির্ধারণ করা হয় পরিবারের প্রেস্টিজের কথা চিন্তা করে। সত্যিকার অর্থে ছেলেটি এই পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে পারবে কিনা অথবা মেয়েটি আদৌ কোনদিন এই অর্থ পাবে কিনা তা চিন্তাও করা হয় না। আরো মজার বিষয় হলো, বিয়ের আলোচনায় এই দেনমোহর নিয়ে হঠাৎ করে গজানো মামা-খালা-চাচা-নানা-আপুরাই বেশি এক্সাইটেড থাকে। কোন কোন বাবা-মা তো এভাবে বলেন, "ওমুকের মেয়ের বিয়েতে দেনমোহর দশ লক্ষ টাকা ছিলো। আমার মেয়ের বিয়েতে বিশ লক্ষ না হলে বিয়েই দেবো না।" এই বাবা-মা কখনোই ভেবে দেখেন না তাদের মেয়ে এই অর্থ কখনো পাবে কিনা। অথবা এই বিরাট অংকের দেনমোহরের কারণে তাদের মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে অশান্তিতে থাকবে কিনা।

আমাদের সমস্যাটা হলো আমরা সবকিছুকেই লৌকিক করে ফেলেছি। 'মানুষ কি ভাববে'- এটাই আমাদের চিন্তাকে দখল করে রাখে। বাস্তবতার চাইতে মানুষকে দেখানোটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিয়েতে দেনমোহর একান্ত ছেলে-মেয়ে এবং পরিবারের মধ্যকার বিষয়। এটা এক ধরণের ইবাদাত। অথচ আমরা এটাকে গুনাহের কারণ বানিয়ে ফেলেছি। বিয়ের মতো সহজ একটা ব্যপারটা আমরা ক্রমশই জটিল করে ফেলছি।

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

Nostro, Vostro এবং Loro account

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন