একশত বিশ মিনিট এবং একটি নেড়ি কুকুর
অপেক্ষমান মানুষের ভীড়ে তিনি যখন এসে
দাঁড়ালেন, তখন শেষ বিকেলের আলো মেঘের সাথে লুকোচুরি খেলছে। মেঘের কিনারা ঘেষে নেমে
আসা বর্ণালী উপভোগের ফুসরত তার নেই। তিনি তাকিয়ে আছেন জ্যামে আটকে থাকা গাড়িগুলোর
দিকে। তার চোখ খুঁজছে কল্যাণপুর যাবার বাস। তার সাথে আরো অনেক মানুষ দাঁড়ানো।
বৃদ্ধ, শিশু, নারী- একেকজনের গন্তব্য একেক জায়গায়। কিন্তু সবার মধ্যেই একটি জিনিস
খুব বেশি মিল- সবার চোখেই ক্লান্তি, হতাশা। তার বাম পাশের ছেলেটিকে তিনি দেখছেন।
কিছুক্ষণ আগেই হয়তো অফিস থেকে বের হয়েছে। ঘামে ভেজা চোখ-মুখ। সারাদিন প্রচন্ড
পরিশ্রম করে হয়তো বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নেবে। তার সামনেই এক ভদ্র মহিলা। এক হাতে
অফিস ব্যাগ, অন্য হাতে সবজি ভরা বাজারের থলে। এভাবে এই মহিলা বাসে উঠবে কিভাবে?
অথচ তাকে তো বাসায় যেতেই হবে। হয়তো তার ছোট্ট বাচ্চাটি তার কোলে ওঠার জন্য সকাল
থেকে বসে আছে। একটু দূরে এক যুবক এক হাত দিয়ে স্ত্রীর হাত এবং আরেক হাত দিয়ে বৃদ্ধ
মায়ের হাত শক্ত করে ধরে আছে। এরা কোথায় যাবে কে জানে? দীর্ঘক্ষণ পর পর একটি করে
বাস আসে। যুবক এগিয়ে যায়। হয়তো যুদ্ধ করে আর দশজনকে মাড়িয়ে সে বাসে উঠতে পারবে,
কিন্তু তার স্ত্রী আর মায়ের কি হবে? এভাবে যাওয়া যাবে না। সিএনজি অটো রিক্সা দেখা
মাত্র সে দৌড়ে যাচ্ছে। “ভাই, মহাখালী যাবেন?”
-না, যামু না।
-খালিইতো যাচ্ছেন ভাই। ভাড়া বাড়িয়ে
দেবো...সাথে রোগী আছে। দিয়ে আসেন না ভাই?
-কইলাম তো যামু না। রাস্তায় জ্যাম দেখছেন।
নিরাশ হয়ে বেচারা ফেরত আসে। আরেকজন দৌড়ে যায়।
-এই সিএসজি, যাবা?
-কই?
-মোহাম্মদপুর।
-না, যামু না।
-কেন যাবা না?
-যামু না কইলাম তো।
-শালা বাস্টার্ডের বাচ্চা, যাবি না মানে?
তোর বাপ যাবে। এই শুয়োর.....
একঘন্টা হতে চললো তিনি বাসের অপেক্ষায় ঠায়
দাঁড়িয়ে আছেন। এর মধ্যে কেবল একটি বাস এসেছে। ভেতরে, ছাদে যাত্রী বোঝাই। কেউ
হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে আছে। রাস্তায় দাঁড়ানো দু’একজন এগিয়ে গিয়েছে কিন্তু ওঠার সাধ্য
হয়নি। শত শত প্রাইভেট কারের স্রোতে বাসগুলোকে বড় বেমানান লাগে। হর্ণের প্রচন্ড
শব্দ সূচের মতো মাথায় বিধে যায়। বাংলাদেশের ড্রাইভারদের গাড়ির হর্ণের প্রতি বেশ
দূবর্লতা আছে। এরা কারণে, অকারণে হর্ণ বাজাবে। তিনি আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যান। কোন
লাভ হয় না। আবার আগের জায়গায় ফিরে আসেন। তার সহযাত্রী আরো শ’খানেক মানুষ। কেউ কথা
বলে না। কেবল একবুক আশা নিয়ে একটি বাসের জন্য অপেক্ষা করে। আরো আধা ঘন্টা পার হলো।
দু’পাশের রাস্তা বন্ধ করে একজন ভিভিআইপি প্রচন্ড বেগে তার গাড়ির বহর নিয়ে চলে
গেলেন।
তার বুকে ব্যাথ্যা হচ্ছে। গাড়ির প্রচন্ড
শব্দে মাথা ঘুরাচ্ছে। মনে হচ্ছে তিনি অবাস্তব কোন জগতে চলে এসেছেন। তিনি একেবারে
রাস্তার উপরে দাঁড়ানো। গা ঘেষে মোটর সাইকেলগুলো চলে যাচ্ছে। সেগুলোর বাতাসে তার
ঘামে ভেজা জামা উড়ছে। তিনি এখনো আশা করে আছেন বাস পাবেন। মারামারি করে হলেও বাসে
উঠতে হবে। আরো কিছু সময় পার হয়। মানুষগুলো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি ভাবছেন,
সময় কি থেমে গেছে? আধা বাস্তব- আধা অবাস্তব ঘোরের মধ্যে তিনি কুকুরটিকে দেখতে পান।
নেড়ি কুকুর। বেশ আমোদ করে বসে বসে শরীর চুলকাচ্ছে। হাই তুলছে। ওর কোথাও যাবার তাড়া
নেই, কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করে নেই। গাড়ির প্রচন্ড শব্দ, মানুষের চিৎকার-চেচামেচি,
গাড়ির ধোয়া- কোন কিছুই ওর শান্তি নষ্ট করতে পারছে না। মনে হচ্ছে কুকুরটি সন্ধ্যার
আলো-ঝলমলে ব্যস্ত শহরে দু’পেয়ে মানুষগুলো দুর্ভোগ দেখে হাসছে। মানুষ সভ্য হয়েছে,
উন্নত হয়েছে, গতি পেয়েছে- সেই সাথে পাল্লা দিয়ে অর্জন করেছে নিজের দুর্ভোগ। ভদ্রলোক
কুকুরটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি দু’পেয়ে কিছু মানুষ-কুকুরের সাথে এই নিরীহ
কুকুরটিকে মেলানোর চেষ্টা করছেন। এরা নিজেদের স্বার্থে অন্য মানুষদের জীবনকে
দুবির্ষহ করে তুলছে। গণপরিবহনের কৃত্রিম সংকট তৈরী করে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে
এরা ভোগান্তিতে ফেলছে। মনে মনে একটি অশ্লীল গালি উচ্চারণ করেন এদের উদ্দেশ্যে।
পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নেন। নাহ, নিরীহ এই কুকুরের সাথে এই মানুষগুলোর তুলনা করলে
এই কুকুরগুলোকেই অপমান করা হয়। তীব্র ঘৃণায়, সামনের পিচ ঢালা কালো রাস্তায় এক দলা
থু তু ফেলেন । নিয়ন লাইটের আলো সেটিতে প্রতিফলিত হয়ে জ্বল জ্বল করছে। তিনি ঘড়ির
দিকে তাকান। দু’ঘন্টা পার হয়েছে। একশত বিশ মিনিট। নেড়ি কুকুরটি তখনো সেখানে বসে
আছে। তিনি রাস্তার দিকে তাকান, হয়তো কল্যাণপুর যাবার একটি বাস আসছে।
Comments
Post a Comment