রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

ড. বার্ট গায়েন

বিগত ২০১৭ সালের শেষ চার মাস খবরের শিরোনাম জুড়ে ছিলো রোহিঙ্গাদের অবর্ণনীয় মানবিক বিপর্যয়ের সংবাদ। সংখ্যায় প্রায় ১০ লক্ষ এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস মায়ানমারে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে বাংলাদেশের সীমান্তের পাশে অবস্থিত রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত এই রোহিঙ্গাদের মায়ানমার সরকার অবৈধ অধিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। এমনকি সরকারিভাবে যে ১৩৫টি জাতিগোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে সেখানেও তাদের নাম নেই। সরকারিভাবে বাঙালি হিসেবে বিবেচিত এই রোহিঙ্গারা ইতিপূর্বেও বহুবার ধর্মীয় সহিংসতার শিকার হয়ে বাস্তুভিটা থেকে বিতাড়িত হয়েছে এবং ১৯৭৮ সালে দুই লক্ষ, ১৯৯১-৯২ সালে আড়াই লক্ষ এবং ২০১২ সালে একলক্ষ চল্লিশ হাজারের মতো রোহিঙ্গা জনগণ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য ইতিপূর্বের এই জাতিগত বৈষম্য আন্তর্জাতিক মনোযোগ খুব একটা আকর্ষন করতে না পারলেও গেলো ২০১৭ সালে মায়ানমান সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাদের উপর একাধিক সহিংস অভিযানের ফলে সংগঠিত গণহত্যা এবং জাতিগত নিমূলের মতো ঘটনার অভিযোগ উঠতে থাকলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো মনোযোগ দেয় রোহিঙ্গা ইস্যূতে।

বেশ কিছু কারণে অতীতের তুলনায় এখনকার এই সংকট আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বেশি পর্যবেক্ষিত হচ্ছে। প্রথমত, বর্তমান সংকটের ব্যাপ্তি এবং মানুষের উপর এর চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভোগ পরিমাণগত দিক থেকে অনেক বেশি। প্রায় ৬ লক্ষের উপর রোহিঙ্গা মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে যারা এখনো পর্যন্ত শরনার্থী শিবিরগুলোতে আটকে আছে। এছাড়া সীমান্তের ভেতরে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যাটাও লক্ষাধিক। ২০১৭ সালে নবগঠিত স্বাধীনতাকামী সশস্র বিদ্রোহী গ্রুপ ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) সরকারী পুলিশ ফাঁড়িগুলোতে একাধিক আক্রমন চালায়। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মায়ানমার আমর্ড ফোর্স ‘আরসা’র বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করলে আক্রান্ত হতে থাকে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো- শুরু হয় এই মানবিক সংকটের।

সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের দু:খ-দুর্দশার প্রতি আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষনের কারণ হলো ২০১১ শুরু হওয়া মায়ানমারের প্রশংসিত রাজনৈতিক পুর্নগঠন প্রক্রিয়া এবং গনতান্ত্রিকরণ যার কিছুই রাখাইন রাজ্যে প্রতিফলিত হয়নি। অস্ত্রবিরতী, বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর সাথে পুনরায় চালু হওয়া আলোচনা সহ উদারতা, স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক পুর্নগঠনের দিকে যে অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে তার সাথে রোহিঙ্গাদের উপর এই নিপীড়নকে সম্পূর্ণ বিপরীত হিসেবে দেখা হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে এই সমস্যা সমাধানে গণতন্ত্রের আইকন এবং শান্তিতে নোবেল পুরুষ্কার বিজয়ী অং সাং সুচির ব্যার্থতা। ২০১২ এর মাঝামাঝিতে মায়ানমার পার্লামেন্টে শপথ গ্রহনকারী সুচি যিনি পরবর্তীতে ২০১৫ এর নির্বাচনের পর স্টেট কাউন্সিলর, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এবং রাষ্ট্রপতির দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে মনোনীত হন, অতীতে একাধিকবার রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে কিনা এ ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি পরিস্কারভাবে একদিকে আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং অন্যদিকে অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সমর্থন ও সেনাবাহিনীর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ হারানোর ভয়ের মধ্যে রয়েছেন। এটা মনে রাখা দরকার যে মায়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে তাদের সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে যার মধ্যে স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত সম্পর্কিত মন্ত্রনালয়ও অর্ন্তভুক্ত।

পশ্চিমা সরকার এবং মিডিয়াগুলো প্রায় একই ভাষায় এই সংকট নিরসনে মায়ানমার সরকারের, বিশেষ করে সুচির অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করেছে। সেনাবাহিনী কর্তৃক সংগঠিত এই অভিযানের বিপক্ষে উচ্চ কণ্ঠে প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হওয়ায় পশ্চিমারা এটিকে সুচির ‘লজ্জাজনক নীরবতা’ এবং ‘বেপরোয়াভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন মেনে নেওয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অন্যদিকে এশিয়ার অন্য দেশগুলোও আরো জোরালোভাবে এই সংকটের সমালোচনার করা থেকে বিরত রয়েছে । উদাহরন হিসেবে বলা যায় গত ৫ ডিসেম্বর, ২০১৭ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত রোহিঙ্গা পরিস্থিতি বিষয়ে উত্থাপিত ‘নিন্দা প্রস্তাবের’ উপর অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে জাপান ভোট প্রদান করা থেকে বিরত থাকে। তাদের মতে প্রথমে এই পরিস্থিতির কারণ অনুসন্ধানে মিয়ানমারের সাথে আলোচনা-সংলাপ হতে হবে। উদ্ভুত পরিস্থিতির ব্যাপারে সমালোচনা, মিয়ানমারকে চাপ দেওয়া বা সম্ভাব্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলা থেকে জাপানের এই বিরত থাকা বিষয়টিকে মিয়ানমারে জাপানের অর্থনৈতিক স্বার্থ, দেশটিতে চীনের সাথে প্রতিযোগীতা এবং বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে জড়িত হবার জন্য গৃহীত নীতির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

প্রথমত উল্লেখ করা যায়, বিভিন্ন দেশে জাপানের ‘অর্থনৈতিক সহযোগীতা’ বা ‘উন্নয়ন সহযোগীতা’ প্রকল্প সমূহ হচ্ছে তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ যেখানে জাপানি কোম্পানীগুলোর সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জাপান সরকার জনগণের তহবিল বিদেশের মাটিতে বিনিয়োগে করে থাকে। মিয়ানমারের রাজনৈতিক পুর্নগঠনের শুরু থেকেই জাপান দেশটিতে তাদের সম্পৃক্ততা পুনরায় শুরু করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছে যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পূর্বের ঋণ মওকুফ, পুনরায় ঋণ প্রদান এবং নতুন বিনিয়োগ শুরু করা। ২০১৩ সালে জাপান মিয়ানমারের ৫০০ বিলিয়ন ইয়েনের (প্রায় ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের) খেলাপি ঋণ মওকুফ করে দেয় এবং সেই সাথে খুব অল্প সুদে পুনরায় ৫০ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৫৭০ মিলিয়ন ডলার) মিয়ানমারকে ঋণ প্রদান করে। নভেম্বর ২০১৭ তে টোকিও নতুন করে মিয়ানমারকে ১১৭ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার) ঋণের প্রস্তাব দেয়। এছাড়াও ইয়াংগুনের ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে ‘তিলোয়া’তে জাপানের পরিচালিত ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রকল্পে ‘জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)’র খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ‘জাইকা’ হচ্ছে এমন প্রতিষ্ঠান যাদের বেসরকারি-প্রকল্পে বিনিয়োগকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে সুমিটোমা, মারুবেনি এবং মিতসুবিশির মতো জাপানের প্রথম সারির শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সে দেশের বিভিন্ন স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পে জড়িত বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ প্রদান করে।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ভূ-কৌশলগত দিক দিয়ে মায়ানমার এমন এক স্থানে অবস্থিত যেখানে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে নিয়ন্ত্রনের জন্য জাপান চীনের সাথে প্রতিযোগীতা করছে। মায়ানমার জাপানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তার অর্থনৈতিক সুবিধা, প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম শক্তি এবং ভোগ্যপণ্যের বাজারের কারণে। এছাড়াও জাপানের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ভারতীয় উপসাগরে প্রবেশদ্বার হিসেবে মিয়ানমারের ‘থিলাওয়ালা’ সামুদ্রিক বন্দর কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ যা কিনা জাপানের পরিচালিত বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিকটেই অবস্থিত। মালাক্কা প্রণালিকে এড়িয়ে দক্ষিণপূর্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার সাথে সংযোগ উন্নয়নের জন্য একটি করিডোর গঠনে এই বন্দর বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। রোহিঙ্গা ইস্যূতে মিয়ানমার সরকারের বিপক্ষে জাপানের যে কোন জটিল অবস্থান এই সংযোগ অঞ্চল নির্মাণসহ চীনের সাথে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রতিযোগীতায় জড়িত জাপানি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

অবশেষে বলা যায়, ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বার্মা নামে পরিচিত মায়ানমারের সাথে রোহিঙ্গা ইস্যূতে জাপানের নীরব অবস্থান দেশটির প্রতি টোকিওর ঐতিহাসিক নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সামরিক শাসনের পুরো সময় জুড়ে গনতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য জাপান দেশটিতে মানবিক সাহায্য প্রেরণ এবং সরাসরি বিভিন্ন সাহায্য-সহযোগীতমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলো। পরিবর্তন অর্জনের জন্য ক্রমাগত সাহায্যমূলক সম্পর্ক যে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই ধারণাটিকে জাপান সাধারণভাবে সমর্থন করতে থাকে। মোটের উপর জাপানের লক্ষ্য ছিলো অবরোধসহ সকল বিষয়ে পশ্চিমা এবং এশিয়ান প্রেক্ষাপটের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করা।

জাপানের এই ‘তৃতীয় পন্থা’র লক্ষ্য হলো বৈশ্বয়িক মূল্যবোধের সাথে অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রকে দেশটির স্থায়ী উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া এবং একই সাথে অবরোধ তুলে নেওয়ার জন্য কাজ করা। যখন পশ্চিমা শক্তি মায়ানমারের উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করেছে এর বিপরীতে জাপান অবস্থান ছিলো দেশটির বিভিন্ন বিষয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করে বন্ধুসুলভ নীতির অনুসরণ করা। এই পদক্ষেপ জাপানকে আমেরিকার সাথে এমন একটি স্থুল সম্পর্কের স্থানে নিয়ে এসেছে যেটিকে আমেরিকা ‘পারস্পারিক আমেরিকা-জাপান মূল্যবোধ’র বিপরীত বলে সমালোচনা করছে। এই সময় এসকল প্রত্যক্ষ সমালোচনার প্রেক্ষিতে নীরব থাকার প্রভাব বা অবরোধ বিষয়ে বির্তক উত্থাপিত হতে পারে কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে দেখা যাচ্ছে যে পূর্বের পদক্ষেপই মায়ানমারে জাপানের স্বার্থকে সংরক্ষিত করার জন্য বেশি কার্যকরী। আর এটা এমন একটা সময় যখন জাপান প্রকাশ্যে এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে মোকাবেলার সংকল্প নিয়েছে।


ড. বার্ট গায়েনস ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সহযোগী অধ্যাপক এবং ফিনিস ইন্সটিটিউট অব ইন্ট্যারন্যাশনাল এফেয়ারস’র সিনিয়র রিসার্স ফেলো। ‘জাপান টুডে’ হতে ভাষান্তরিত।