আমি কুকুর ও মানুষের পার্থক্য করতে শিখেছি

সরকারী হলুদ দালান, তার সামনে জড়ো হয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্দোলন করছেন। একাধিক দাবী-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও ঘন্টা খানেকের মধ্যে তা ‘এক দফা-এক দাবী’তে পরিণত হয়। সমস্যা হলো, অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও এই এক দফা দাবীটা যে কি, সেটাই বুঝতে পারি নাই। প্রথমে তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘আমাদের দাবী মেনে নাও- মানতে হবে মেনে নাও’। শীতের সকালের আমেজ কেটে বাড়ছে রোদের উত্তাপ। রোদের গরমেই কিনা কে জানে, তারা তখন স্লোগান দিতে লাগলো ‘অমুকের গদীতে, আগুন জ্বালো এক সাথে’। আন্দোলনকারীরা পত্রিকা বিছিয়ে রোদ পোহাতে পোহাতে বাদাম চিবুচ্ছিলেন আর শ্লোগান দিচ্ছিলেন। তারা কষ্ট করে উঠে কারো গদিতে আগুন লাগাবে এমন কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। বক্তব্য দিতে দিতে নেতার গলায় মনে হয় স্ক্র্যাচ টাইপ কিছু হয়েছে। কথা কেমন ফেটে ফেটে বের হচ্ছে। এরপরেও নিকট ভবিষ্যতে তিনি বক্তব্য থামাবেন বলে মনে হলো না। বেলা বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে আন্দোলনের উত্তাপ। এমনিতেই আমরা জাতি হিসেবে আন্দোলন প্রিয়। দাবী আদায় হলো কি হলো না, সেটা বড় কথা না। কাজ-কর্ম বন্ধ করে আন্দোলন করাতেই আমাদের বিরাট আনন্দ। তো, কিছুক্ষণের মধ্যেই নেতা ঘোষনা দিলেন, আমরা কর্তৃপক্ষকে রোববার পর্যন্ত সময় বেঁধে দিলাম। এই সময়ের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে রোববার থেকে তীব্র আন্দোলন শুরু হবে। আজকের মতো যার যার কাজে সবাইকে ফিরে যাবার জন্য অনুরোধ করলেন তিনি। এরপর শুরু হলো ক্লাইমেক্স। শ্রোতাদের মধ্য হতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে লাগলেন, কোন নেতা মানি না- দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত কাজে ফিরে যাবো না। ‘অমুকের দালালেরা, হুশিয়ার সাবধান’, ‘এক দফা, এক দাবী- মানতে হবে, মেনে নাও। অবস্থা পুরোই বেকায়দা। মুহুর্ত্বের মধ্যে নেতা হয়ে গেলেন দালাল। এতোক্ষণ নেতা স্লোগান দিচ্ছিলেন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্বে। এখন তার কর্মীরা স্লোগান দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে।

সরকারী এই অফিসে আমাদের কাজটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কাজটা আজকে না হলে আমরা এবং আমাদের ক্লায়েন্ট উভয়েই বেশ বড় ধরণের সমস্যায় পড়ে যাবো। সুতরাং, কষ্ট করে হলেও কাজটা আজকেই করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই সরকারী এই অফিসে সাত-সকালে আমাদের আসা। কিন্তু বিধি বাম। তিন দিন ধরে নাকি এই আন্দোলন চলছে।

অফিসের বিরাট বারান্দায় আমরা কয়েকজন এতিমের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। বেশিরভাগ ডেস্কেই কেউ নেই। সবাই অফিসের সামনে জড়ো হয়ে দাবী-আদায়ের স্লোগান দিচ্ছেন। আজকে তারা কাজে ফিরে যাবেন, এমনও মনে হচ্ছে না। ঘন্টা দু’য়েক ঘুরা-ঘুরি করে অফিসের একজনকে ধরলাম কাজটা করে দেবার জন্য। তিনি পেছনে দু’হাত বেঁধে হেলে-দুলে কোথায় যেনো যাচ্ছিলেন। আমাদের কথা শুনে প্রথমে বিরাট একটা গম্ভীর ভাব নিলেন। এরপর বাম হাত দিয়ে নাকের ময়লা পরিস্কার করতে করতে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, কাজ হবে- এক লাখ লাগবে। কথা শুনেই মাথা গেলো গরম হয়ে। হারামির বাচ্চাটার নাক বরাবর যদি একটা ঘুষি মারতে পারতাম! পাশে তাকিয়ে বুঝলাম আমার বসের মাথা আমার থেকে কিঞ্চিত বেশি গরম হয়ে গেছে। কারণ তিনি ততক্ষণে মুখ দিয়ে কিছু খাঁটি বাংলা শব্দের উচ্চারণ করে ফেলেছেন। বাই দ্যা ওয়ে, পরে চিন্তা করে দেখলাম একজন ‘সম্মানিত’ সরকারী কর্মচারীর প্রতি এই জাতীয় ‘নীরব’ আক্রমন করাটা আমাদের ‘বে-আক্কেল’ সুলভ আচরণ। শত হোক, তেনারা এখন আগের থেকে দ্বিগুণ বেশি বেতন-ভাতা পান। সো, এখন তাঁরা আমাদের মতো আম-জনতার কাছ থেকে আগের চে’ দ্বিগুণ বেশি সম্মান এবং ‘বখশিস’ ডিজার্ভ করেন, তাই না?

যাই হোক, কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো। ‘এক লাখ’ওয়ালা ভাই বিরস বদনে তার ডেস্কে ফিরে গেলেন। আমরাও কিছুটা স্বস্তি পেলাম। যাক, এবার অল্প ‘খরচা-পাতি’র উপর দিয়ে কাজটা শেষ করতে পারলেই হয়। বড় অফিসারও তার রুমে ঢুকলেন। অল্প বয়েসি, লম্বা এবং বেশ স্মার্ট এই অফিসার। চেহারা-সুরতে সিনেমার হিরো হিরো একটা ভাব আছে। বছর খানেকের বেশি হয়নি সার্ভিসে জয়েন করেছে। তো গতানুগতিক প্রক্রিয়া শেষ করে আমাদের প্রতিনিধি ফাইল নিয়ে বড় অফিসারের সামনে গেলেন সাইন করানোর জন্য। আমরা বাহিরে দাঁড়িনো। রুমের ভেতরে আমাদের প্রতিনিধি এবং অফিসারের কথা-বার্তার কিছু অংশ এমন-

-স্যার, ফাইলটা যদি দেখে দিতেন।

- (ফাইল উল্টে-পাল্টে) এটা তো অমুক কাজের ফাইল।

-জ্বি স্যার।

-আপনে জানেন না এটার জন্য কত দিতে হয়? উনি (ওনার রুমের বাহিরের আরেক অফিসারকে ইঙ্গিত করে)

কিছু বলেন নাই?

-না স্যার, বলেন নাই।

-আচ্ছা ঠিক আছে। বিশ হাজার দেন।

- কি বলেন স্যার? আগে তো এতো লাগতো না।

-আগে লাগতো না, এখন লাগে।

-স্যার, পার্টিতো এতো টাকা ক্যাশ আনে নাই। পাঁচ হাজার দিবো। করে দেন।

- (স্যারের পেছনের পিয়ন বেশ গরম হয়ে) ক্যাশ আনে নাই তো কাজ নিয়ে আসছে কেন? আচ্ছা ঠিক আছে, পনেরো দিয়েন। স্যার করে দিবে।

- না স্যার, এতো পারবো না। আরো খরচ তো আছে।

‘স্যার’ শেষ পর্যন্ত দশ হাজারে কাজটা করে দিয়েছেন। আর স্যারের পিয়ন, অফিসের অন্যান্য ‘দ্বিগুণ সম্মানে’র অধিকারীগন, যাদের কোন কাজ নাই তারাও প্রত্যেকে হাজার খানেক করে ‘বখশিস’ আদায় করেছেন। ওহ্, সেই ‘এক লাখ’ওয়ালা ভাইও শেষ পর্যন্ত এক হাজার টাকার একটা নোট ভাগে পেয়েছেন। আমাদের কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়েছে। এই কাজের জন্য আমাদের একজন সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে বহু কাঠ-খড় পুড়িছে দেশে এসেছেন। আরেকজন আশি বছর বয়েসি মুরুব্বি অফিসের বাহিরে চার ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে বসে ছিলেন। আমরা এবং অন্য শ’খানেক মানুষের কথা বাদই দিলাম। আর টাকা খরচ? ধূর ভাই, বাদ দেন না। আপনার গেটের বাহিরে ঘুর ঘুর করা নেড়ি কুত্তাটা যখন আপনার পথ আটকে রাখে তখন তো সেটাকেও আপনি দয়া করে কিছু খেতে দেন, তাই না? এসব কি আর হিসেবের মধ্যে ধরা যায় নাকি?

হন্তদন্ত হয়ে যখন ব্যাংকে ঢুকি তখন ঘড়িতে একটা বেঁজে এগারো মিনিট। ভেতরে ঢুকেই নোটিশটা চোখে পড়লো, “একটা পনেরো থেকে দুইটা পর্যন্ত নামায ও লাঞ্চের বিরতি’। হইছে কাজ। পুরোপুরি বে-টাইমে আমার আগমন। প্রতিষ্ঠানখানা আবার সরকারী। যা বোঝার বুঝে গেলাম।

আমাকে তাড়াহুড়ো করে ঢুকতে দেখে পঞ্চাশোর্ধ ছোটো-খাটো, গলায় কমদামী মাফলার জড়ানো এক লোক কাছে এগিয়ে এলেন। হাতের ভাউচারের দিতে তাকিয়ে বল্লেন, পে-অর্ডার করবেন? আমার কাছে দেন। এই লোক দালাল, নাকি ব্যাংকের কেউ চিন্তা করতে করতেই ভাউচার এগিয়ে দিলাম। ডেস্ক ঘুরে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বল্লো, টাকা দেন, চেক করি। বুঝলাম ব্যাংকের অফিসার। টাকা এগিয়ে দিলাম। টাকা চেক করলেন, ভাউচার সাইন করালেন, সেই ভাউচার অন্য টেবিলে নিয়ে গেলেন, সেখান থেকে অন্য অফিসারের কাছে গিয়ে চেক লেখালেন, সেটা আরেকজনের কাছে নিয়ে সাইন করিয়ে আমার হাতে দিয়ে বল্লেন- নেন, কাজ কমপ্লিট। বিলিভ মি, আমি এই কাজ আগে করেছি সর্বনিম্ন চল্লিশ মিনিটে। আর এখন চার মিনিটে! চেকটা রিসিভ করে তার হাত ধরে বলেছি, স্যার- থ্যাংক ইউ। এন্ড এগেইন বিলিভ মি, ‘মানুষ’টাকে কথাটা মন থেকেই বলেছি।

Comments

  1. এটাই হল সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আসল চরিত্র। ঘুষ ছাড়া এরা কিছুই বুঝে না।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account