জীবনে থামতে জানতে হবে : মারিয়া শ্রিভার

এই প্রবন্ধটি প্রথম আলো'তে ০৩ নভেম্বর, ২০১৩ প্রকাশিত হয়। সংগ্রহে রেখে দিলাম।


[মার্কিন সাংবাদিক ও লেখক মারিয়া শ্রিভারের জন্ম ১৯৫৫ সালের ৬ নভেম্বর। মারিয়া ছয়টি বেস্ট সেলিং বইয়ের লেখক। দ্য আলজেইমার প্রোজেক্ট টিভি শোর জন্য তিনি দুটি এমি এবং অ্যাকাডেমি অব টেলিভিশন আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স পুরস্কার লাভ করেন।]
সূত্র: ২০১২ সালের ১১ মে এনেনবার্গ স্কুল ফর কমিউনিকেশন, পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটিতে দেওয়া বক্তৃতা। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: মনীষ দাশ]

শুভ সকাল। সমাবর্তনে অংশ নেওয়া সব শিক্ষার্থীকে শুভেচ্ছা। শিক্ষার্থীরা, তোমরা এই মুহূর্তে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে এমন এক পৃথিবীতে পা দিতে যাচ্ছ, যেখানে যোগাযোগই আসলে সবকিছু। দেশীয় সীমানা, সময়ের পার্থক্য, অর্থনৈতিক অবস্থান—সবকিছুকে উপেক্ষা করে সারা পৃথিবীর মানুষ এখন প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে যাচ্ছে একে অন্যের সঙ্গে। যোগাযোগের ধারণাকেই আমূল পাল্টে দিয়েছে কম্পিউটার, খুদেবার্তা, বিভিন্ন অ্যাপস, গেমস ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। তার ও বেতার, যেকোনো মাধ্যমেই আমাদের পাশের রুম থেকে পৃথিবীর অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত আমরা এখন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ করতে পারি। এটা এখন আমাদের জীবনের একটা অংশে পরিণত হয়েছে। তোমাদের কাছে যোগাযোগ হচ্ছে শ্বাস নেওয়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
তোমরা এখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছ। তোমাদের কাজের মাধ্যমে পৃথিবীর যোগাযোগের মাধ্যমকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন তোমরা নিশ্চয়ই দেখ। কিন্তু এটা আসলে একটা প্রতিযোগিতার মতো। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে যে তুমিই প্রথম ও নতুন। তুমিই পরবর্তী সেই জন, যে পৃথিবীকে বদলে দিতে পারে। এটা রোমাঞ্চকর ও একই সঙ্গে অনেক ভয়েরও।
আমি মনে করতে পারি জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমাবর্তন দিনের কথা। আমি সেদিন খুবই উদ্বিগ্ন ছিলাম; কারণ আমি একটি টিভি চ্যানেলে চাকরির আবেদন করেছিলাম, কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। প্রত্যেকই সেদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, স্নাতক হওয়ার পর আমি কী করব। আমি কোথায় কাজ করব। নিজের জন্য সেদিন আমার খুবই খারাপ লাগছিল, কারণ আমার কাছে প্রশ্নগুলোর উত্তর ছিল না।
আমি জানি, তোমরা এখন সেই প্রশ্নগুলোরই মুখোমুখি হচ্ছ, যেগুলো একসময় আমাকে করা হয়েছিল। তুমি কোথায় চাকরি করবে, কত টাকা বেতন পাবে, তুমি কোথায় থাকবে, কখন বিয়ে করবে, কখন সন্তান নেবে—এ রকম হাজারো প্রশ্ন। জীবনের ফার্স্ট ফরওয়ার্ড বাটনে চাপ দিতে তোমাদের আর কিছু সময় মাত্র দেরি। কিন্তু আমি চাইব এর আগে তোমরা আরেকটি কাজ করতে জান, সেটা হলো থামার বাটনটি চাপ দিতে। আমার আজকের কথা থেকে আমি চাই তোমরা একটি জিনিসই শেখো, সেটা হলো থেমে যাওয়ার শক্তি। তোমার কর্মজীবনের ব্যস্ততার মধ্যে একটু সময় থেমে থাকো, শ্বাস নাও, নিজের সঙ্গে কথা বলো, নিজের চারপাশকে দেখো, সেই মুহূর্তটিকে অনুভব করো। যখন সবাই উদ্ভ্রান্তের মতো চারদিকে ছোটাছুটি করবে, আমি তোমাদের বলব সাহসের সঙ্গে এর বিপরীত কাজটি করতে।
সমালোচনা আর ভুল বের করা নয়, তোমাদের কাজ হচ্ছে মানুষের মনোভাব বোঝা আর সহানুভূতিশীল হওয়া। অস্বীকার করা ও হতাশা ছড়ানো বাদ দিয়ে তোমরা মানুষের ভালো কাজগুলোকে প্রশংসিত করবে ও উৎসাহ দেবে। অন্যায় ও দুর্নীতির পথ নয়, তোমরা বেছে নেবে সততা ও স্বচ্ছতার পথ। তোমাদের কাজ বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর হবে। তোমরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ো, অজানাকে জানো। আমাদের দেখিয়ে দাও তোমাদের প্রতিভার ধার। এমন কিছু করো, যেটা একসময় অসম্ভব ছিল। এ সবকিছুই তোমরা করতে পারবে, যখন তুমি থামতে ও শুনতে শিখবে।
আমি সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছি অনেকভাবেই। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র, ব্লগ, নিজের লেখা বই, ওয়েবসাইট, ম্যাগাজিন, বক্তৃতা—নানাভাবে আমি এ মাধ্যমের সঙ্গে সংযুক্ত। যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করো, কীভাবে এটা সম্ভব হলো? এর উত্তর হবে খুবই সাধারণ, আমি অনেক পরিশ্রম করি। যদি তোমরা সাফল্য পেতে চাও, তোমাদেরও তাই করতে হবে। তোমাদের অনেক কাজ করতে হবে। কিন্তু কাজের মাঝে একটু বিরতি নিতে ভুলো না, যখন তুমি বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রেখে নিজের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তোমার নিজের কাছে কী গুরুত্বপূর্ণ, তুমি কী ভালোবাসো—একটু থেমে এই প্রশ্নগুলো নিজেকে করবে। এভাবেই তুমি তোমার কাজকে ভালোবাসবে এবং নিজের কাছে অর্থবহ করে তুলবে। এডমুন্ড হিলারির সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমি তোমাদের মনে রাখতে বলব, ‘আমরা শেষ পর্যন্ত উঁচু পর্বত জয় করি না, আমরা নিজেদের জয় করি।’
নিজের আবেগ কিংবা আত্মশ্লাঘার বশে কোনো কাজ করো না। থামো এবং নিজেদের ধরে রাখতে শেখো। বর্তমান পৃথিবীতে যোগাযোগের চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। নারীদের আমি বলব, তোমরা নিজেদের কঠোরতা ও কোমলতা, দুটোকেই আবিষ্কার করো। তোমাদের উভয় রূপই পৃথিবীর জন্য দরকারি। পুরুষদের বলতে চাই, তোমরা নিজেদের কোমল অনুভূতিগুলোর যত্ন নাও এবং সেটাকে নিজের শক্তির আবরণে ঢেকে রাখো। মহৎ পুরুষেরা তাই করেন।
জীবনে তোমাদের অনেক পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে হবে। আমি তোমাদের জন্য প্রার্থনা করি, যাতে তোমরা সাহসের সঙ্গে পরিবর্তনের পথে যেতে পারো। যাতে তোমরা তোমাদের চিন্তাকে মুক্ত রাখতে পারো, হূদয়বৃত্তিকে খোলা রাখতে পারো। আমি আশা করি, তোমরা নিজেদের ভয়গুলোকে জয় করবে। অপরের বিচার, নিয়ম ও প্রত্যাশার বাইরে নিজেদের কাজকে পরিচালিত করতে পারবে। নিজের স্বপ্নেই তোমরা বাঁচবে আর নিজের গল্পগুলোকেই লিখবে। এরপর সাহসের সঙ্গে সারা পৃথিবীর কাছে জানিয়ে দেবে তোমার গল্পগুলো, যাতে করে মানুষ তোমার কথা জানতে পারে, তোমার কাছ থেকে শিখতে পারে এবং নিজেদের জীবনে পরিবর্তন আনতে পারে।
সত্যি করে বলতে, আজকে আমি এখানে কথা বলতে পেরে খুবই কৃতজ্ঞ বোধ করছি। আমি আমার জীবনের জন্য কৃতজ্ঞ, যে জীবন আমাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। আমি সেই সব অভিজ্ঞতার কাছে কৃতজ্ঞ, যেগুলো আমাকে সাহায্য করেছে একজন সফল যোগাযোগকর্মী হতে। আমি সবার কাছে আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

Nostro, Vostro এবং Loro account

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন