পোষাক শিল্পে গন্ডগোল, আমি কি ভাবছি?
খুব সকালে যখন আমরা হয়তো সবে ঘুম থেকে উঠবো
উঠবো করছি ততক্ষণে শত শত পোষাক শ্রমিকের ব্যস্ত যাত্রা শুরু হয়েছে নির্দিষ্ট সময়ে
অফিসে পৌছানোর জন্য। তারা যাচ্ছে রাস্তা বাম দিয়ে, ডান দিয়ে, মধ্য দিয়ে। দৃশ্যটা
একেবারে সাধারণ । জেমসের ভাষায় এই পোষাক শ্রমিকেরা সেলাই দিদিমণি। যদিও দাদাভাইও আছে বেশ কিছু। সকালে
সূর্য উঠবে, এটা যেমন আবহাওয়া পূর্বাভাস না শুনেই বলা যায়, তেমনি সাত-সকালে এই
সেলাই দিদিমণিরা হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার ধরে ছুটতে ছুটতে কাজে যাবে, এটাও তাদের
জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনা। এই মেয়েগুলোর বেশিরভাগই ছুটে
আসে গ্রাম বা মফস্বল থেকে। তুলনামূলক একটু ভালো থাকার জন্য। তারা দিনরাত পরিশ্রম
করে দেশের জন্য অত্যন্ত মূল্যবাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। তারা তাদের পরিবারকে
তাদের উপার্জন থেকে সহায়তা করে। তারা হেন করে, তারা তেন করে...ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোটামুটি ছোট বেলায় মুখস্ত করা টোকাই, ফেরিওয়ালা, রিক্সা চালক বা এমন কারও উপরে
লিখা নিরেট বইয়ের ভাষার রচনা। সত্যি বলতে পোষাক কারখানা বা তৈরী পোষাক নিয়ে আমার
মত সাধারণ মানুষের কোন কালেই খুব বেশি আগ্রহ ছিলো না। কিন্তু ইদানিং, আরেকটু সহজ
করে বললে গত বেশ কয়েকবছর ধরে যা শুরু হয়েছে তাতে আমার মত খুব সাধারণ মানুষও চিন্তা
করতে বাধ্য হচ্ছে, আসলে আমাদের পোষাক শিল্পের ভবিষ্যত কি? কি হচ্ছে এখানে? কেন
হচ্ছে? প্রতিদিন টিভির পর্দায় বা পত্রিকার পাতায় পোষাক কারখানার মালিকদের
প্রতিশ্রুতি, সরকারের আশাবাদ আর ঘামে নেয়ে ওঠা শ্রমিকদের উত্তপ্ত দাবী-দাওয়ার
বিবৃতি ডাল ভাতের মতই কমন হয়ে গিয়েছে। আসলেই কি হচ্ছে এসব? বুদ্ধিজীবিরা বলছেন দেশের
বাহিরের এবং ভিতরের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রের কারণে এমন হচ্ছে। এ ওকে গালি দিচ্ছে তো ও
একে কাঁদা ছুড়ছে। হয়তো সত্যিই ষড়যন্ত্র কেউ করছে। সাধারণ মানুষই একজনের উন্নতি আরেকজন সহ্য করতে পারে না। আর এখানেতো
কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্যের বিষয়। হিংসুক প্রতিবেশি থাকলে যা হয় আরকি। অথচ এই বড়
বড় রাঘব বোয়ালের হিংসার বলি সাধারণ শ্রমিকেরা।
আমি কি ভাবছি এই সমস্যা নিয়ে? ঢাকার নামকরা
একটি হসপিটালে যখন ইন্টার্ণী করতাম তখন একটা বিষয় লক্ষ্য করি। সেখানে যে
বায়োকেমিস্ট ভাইয়ার অধীনে আমরা ইন্টার্ণী করতাম, তিনি প্রায় ১২-১৪ ঘন্টা ডিউটি
করতেন। প্রথম প্রমত ভাবতাম, আমাদের কপালেও বোধ হয় চাকরি জীবনে এমন দুর্গতি অপেক্ষা
করছে। ভাবা যায়? একটা লোক ১৪টা ঘন্টা একটা ল্যাবে পড়ে থাকে। মাসের পর মাস। কিছুদিন
পর একটু একটু করে বুঝতে শুরু করলাম। আসলে উনার ডিউটি ৮ ঘন্টাই। তাহলে বাকি সময়?
উনি হসপিটাল কতৃপক্ষের সাথে একটা সমঝোতায় কাজ করতেন। তিনি তাদের বলেছেন অথবা
কতৃপক্ষই তাকে বলেছে, আমাদের তো ল্যাবের জন্য দুই শিফটে দুইজন বায়োকেমিস্ট প্রয়োজন।
এক কাজ করি, আমরা আরেকজন বায়োকেমিস্ট্র নিয়োগ দেবো না। বরং আপনিই আপনার মূল ডিউটির
সাথে অতিরিক্ত হাফ ডিউটি একসাথে করতে পারেন। আমরা আপনাকে সেই অনুযায়ী সম্মানি
প্রদান করবো। হিসাবটা খুবই সহজ। ধরা যাক, ভাইয়ার স্বাভাবিক সম্মানি ছিলো ২৫,০০০
টাকা। তিনি অতিরিক্ত ডিউটি সহ পেতেন প্রায় ৩৫,০০০ টাকা। সেই বায়োকেমিস্ট ভাইয়া
ভাবলেন বিষয়টাতো মন্দ না। আমি অতিরিক্ত ১০,০০০ টাকা আয় করছি। আর হসপিটাল ভাবলো,
বাহ, আমার তো প্রতিমাসে ১৫,০০০ টাকা বেঁচে যাচ্ছে। অথচ এরা প্রতিমাসে কোটি কোটি
টাকার ব্যবসা করে।
এবার পোষাক শ্রমিকদের ব্যাপারটা দেখি। এখানেও
বিষয়টা একই রকম। একজন শ্রমিক স্বাভাবিক ডিউটি করে পায় প্রায় ৩-৪ হাজার টাকা। মালিক
তখন তাদের ওভারটাইমের লোভ দেখায়। একে তো দারিদ্র তার উপর অতিরিক্ত টাকা কামাইয়ের
লোভ। একজন লক্ষটাকা সম্মানি পায় এমন লোককেও যদি আপনি অতিরিক্ত টাকা কামাইয়ের সুযোগ
দেন, সে দৌড়ে যাবে অতিরিক্ত কামাইয়ের জন্য। আর এরা তো খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
হিসাব-নিকাশ আগের মতই। মালিক দুইজন শ্রমিকের জায়গায় খাটায় একজন শ্রমিককে এবং বেতন
দেয় দেড়-জনের সমপরিমাণ। ফলে তারা লাভ করতে পারে অনেক বেশি। কি সাংঘাতিক বুদ্ধী,
তাই না। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে
এমন কর্মপরিবেশ আছে কিনা জানি না। আমাদের পোষাক শ্রমিকরা তাদের বেতন বৃদ্ধির জন্য
আন্দোলনের সোচ্চার। কিন্তু একবারও কিন্তু তাদের বলতে শুনিনি তাদের কর্মঘন্টা আট
ঘন্টাই রাখতে হবে। কারণ এখানে তাদেরও কিছুটা স্বার্থ জড়িত। এতে তাদের শরীরের এবং
মানসিকতার উপর প্রচন্ড চাপ পড়ে। ফলে একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়লে শুরু হয় ভয়াবহ
তান্ডব। কোথাও কোথাও অবশ্য বাধ্য করা হয় ওভারটাইম করতে। কিছু কিছু আন্তজার্তিক
মিডিয়া এই বিষয়টা সামনে নিয়ে আসলেও বিদেশী ক্রেতাদের বড় অংশই এটা নিয়ে তেমন মাথা
ঘামায় না। আসলে পুরো ব্যাপারটাই অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে জড়িয়ে আছে। সহজ করে বলি।
ধরুন একটা ডেনিম জিন্স বানাতে খরচ পড়ে ৪ ডলার। সেটা বিক্রি হয় ৮ ডলারে। এরপর
বিদেশি বায়ার হোল সেল কেনে ১২ ডলারে, এবং ক্রেতারা যখন কেনে তখন ২০ ডলার দিয়ে
কেনে। আর যে শ্রমিক এটা বানাচ্ছে সে হয়তো গড়ে এর জন্য পায় ৩০ বা ৪০ সেন্ট। এখন
মালিক যদি একজনের জায়গায় দুইজন শ্রমিক নিয়োগ দেয়, অথবা শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি করে
তাহলে ব্যাপারটা কি হয়? তখন মালিকের লাভ কমে যায়, বিদেশি বায়ারের লাভ কমে যায় কারণ
২০ ডলারের ডেনিম তারা ইচ্ছা হলেই ২৫ ডলার বিক্রি করতে পারবে না। আর একেকটা অর্ডারে যদি, উদাহরণ স্বরুপ ৫০,০০০ পিচ
প্রোডাক্ট যায়, তাহলে মালিক আয় করছে কমকরে ২ ডলার করে হলেও ৪০০০০০ ডলার। সব খরচ
বাদ দিয়ে মোটামুটি বেশ মোটা অংকের একটা লাভ মালিকের পকেটে ঢুকে যায়। ঢাকাতে এবং
আশে পাশে গড়ে ওটা হাজার খানের তৈরী পোষাক ফ্যাক্টরি দেখলেই বোঝা যায়, কেন এগুলোতে
এতো বড় বড় বিনিয়োগ করা হয়েছে। আর কেনোইবা এই শিল্পের সাথে জড়িতরা কোটি টাকার গাড়ি
হাকায়, বাড়ি বানায় আবার কেউ কেউ তো নিজেই হিরো হয়ে সিনেমা বানায়। মাঝে অভাগা
শ্রমিকের ভাগ্য হয় ভেঙ্গে পড়া দালানের তলে, অথবা ঢামেক এর বার্ণ ইউনিটে।
বিদেশিরা যতই দরদী কথা বলুক, তারা অত্যাধিক মুনাফার লোভেই এদের থেকে পণ্য কেনে। প্রয়োজনে তারা নিজেরাই এখানে পোষাক শিল্প তৈরী করে পণ্য উৎপাদন করে নিয়ে যাবে। কারণ এখানকার মতো এতো সস্তা শ্রমিক, যাদের হাজার খানের টাকা ধরিয়ে দিয়ে অমানুষিক পরিশ্রম করানো যায়। যার লাভ সে করছে, বুদ্ধিজীবিরা বুদ্ধি দিচ্ছে, শ্রমিক বিবৃতি দিচ্ছে, মিডিয়া নিউজ করছে আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। হয় আমরা সবাই অসহায়, অথবা কষ্ট করে সবাই অসহায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছি।
Comments
Post a Comment