নম্বর মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম হতে পারে না : আমীর খান

[প্রথম আলো তার 'স্বপ্ন নিয়ে' পাতায় ২৭ অক্টোবর, ২০১৩ আমীর খানের এই লেখাটি প্রকাশ করে। অসাধারণ কিছু কথা বলেছেন তিনি । পুরো প্রবন্ধটি এখানে রেখে দিলাম। এটি শিক্ষা ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত কিন্তু সামগ্রিক এক ছবি।]


 


প্রথমেই বলতে চাই, আমি কোনো শিক্ষাবিদ নই; আমি একজন সাধারণ অভিনয়শিল্পী— সৃজনশীলতার নগণ্য ছাত্র মাত্র। শিক্ষা নিয়ে আপনারা আমার চেয়ে অনেক বেশি জানেন; দীর্ঘদিন ধরে আপনারা এর সঙ্গে যুক্ত আছেন। কিন্তু কিছুদিন ধরে আমি শিক্ষা নিয়ে ভাবছি। আমার দুটি সিনেমাতারে জামিন পার ও থ্রি ইডিয়টস শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা নিয়ে নির্মিত। এই সিনেমা দুটি করতে গিয়ে আমাকে অনেক গবেষণা করতে হয়েছে। এতে আমি কিছু জিনিস উপলব্ধি করেছি, যা আজকে আপনাদের বলতে চাই।

আজ এখানে শিক্ষাবিদেরা আছেন, অভিভাবকেরা আছেন, অনেক শিক্ষার্থীও আছে। জানি না আমি কতটুকু ভুল কিংবা সঠিক, কিন্তু আপনারা যাঁরা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের কাছে আমার চিন্তাগুলো তুলে ধরাই আমার উদ্দেশ্য।
প্রতিটি শিশুই স্বতন্ত্র, এটা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনার, আমার ও আমাদের সবার মতোই প্রতিটি শিশুরও কিছু ভালো দিক, কিছু খারাপ দিক আছে। বড় হিসেবে, মা-বাবা হিসেবে আমাদের উচিত শিশুদের এই স্বাতন্ত্র্যকে সম্মান করা; তাদের সাহায্য করা—যাতে তারা তাদের পছন্দের কাজটিকে খুঁজে নিতে পারে। তারা সেই কাজটি যেন করতে পারে, যেটিতে তারা আনন্দ পায়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বলে, আমাদের সব শিক্ষার্থী পাস করেছে, বোর্ড পরীক্ষাগুলোতে আমাদের সাফল্য শতভাগ। কিন্তু আমি তাদের কাছে জানতে চাই, আপনাদের কতজন শিক্ষার্থী জীবনে খুশি? আমার কাছে খুশি থাকাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, শেষ পর্যন্ত আমরা পড়ালেখা জীবনে শিখেই ফেলি, কিন্তু সবাই কি সুখী হতে পারি?
থ্রি ইডিয়টস রিলিজ করার আগে আমরা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে আমরা ছবিটি দেখালাম, তাদের কেমন লাগল জানতে চাইলাম। মুম্বাইয়ের এক কারখানা থেকে কিছু শ্রমিকও সেখানে এসেছিলেন; তাঁদেরই একজন আমাকে চমৎকার একটি প্রশ্ন করলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছবিতে আমরা দেখলাম আপনি র‌্যাঞ্চো নন। তাহলে তো আপনি সার্টিফিকেটও পাননি, সেটা জাভেদ জাফরি পেয়েছেন। কিন্তু আপনি এত বড় বিজ্ঞানী হলেন কী করে? এই প্রশ্নটা আসলেই খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটাই আমাদের ছবির মূল বিষয়। পরীক্ষা পাসের জন্য আমরা এত লেখাপড়া করে, নম্বর পেয়ে কী অর্জন করি? স্রেফ একটা সার্টিফিকেট, যেটি আমাকে শিক্ষিত পরিচয় এনে দেয়। কিন্তু আপনি যখন শুধুই জ্ঞানার্জনের জন্য পড়বেন, তখন আপনার কাছে সেই সার্টিফিকেটের কোনো প্রয়োজনই থাকবে না।
আমি সেই শ্রমিকটিকে দুটি প্রশ্ন করলাম। প্রথমটি হলো, আপনি কি মনে করেন আমি ভালো অভিনেতা? জবাবে তিনি বললেন, ‘শুধু আমি না, সবাই মনে করে আপনি ভালো অভিনেতা।’ তখন আমি তাঁকে বললাম যে আমার কাছে এমন কোনো সার্টিফিকেট নেই যেটাতে লেখা আছে যে আমি ভালো অভিনয় করি।
যে কারখানায় সেই শ্রমিক কাজ করতেন, তার মালিককে আমি চিনতাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন যে সেই লোকটি ছিল তাঁর কারখানার সবচেয়ে ভালো কর্মী। এরপর আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি শুনেছি আপনি খুব ভালো কাজ করেন। আপনার কাছে কি এমন কোনো সার্টিফিকেট আছে, যেটা বলে যে আপনি ভালো কর্মী?’ তিনি বললেন, ‘না নেই।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি আপনার উত্তর এখানেই পেয়ে গেছেন।’
আসলে পরীক্ষার নম্বর কিংবা গ্রেডের চেয়েও শিক্ষা অনেক বড় একটা বিষয়। শিক্ষা হলো জানার বিষয়, অনুভবের বিষয়। আমি স্বপ্ন দেখি, ভারতবর্ষে আমরা শিশুদের এমন শিক্ষা দেব যাতে তারা শুধু অনেক তথ্যই জানবে না, ভালো মানুষও হবে। তারা শুধু স্বনির্ভরই হবে না, তারা সম্মানের জীবন যাপন করবে, মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলবে, চলার পথে মানুষকে সাহায্য করবে, তারা চারপাশের মানুষের কথা ভাববে। এ রকম শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের গড়ে তুলতে হবে।
আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, শিশু যখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে, মা-বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করে আজ কত নম্বর পেয়েছ? প্রথম হয়েছ কি না? যদি কেউ প্রথম না হতে পারে, তবে তাকে বকা দেওয়া হয়; আর যদি কেউ খারাপ করে ফেলে তাহলে তো কথাই নেই। এমনকি অনেক মা-বাবা চান সন্তান চামচ মুখে যে দৌড় প্রতিযোগিতা হয়, তাতেও প্রথম হোক। এতে সন্তানের মনে ধারণা জন্মায় যে প্রথম হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সন্তানের বয়স যখন ২১ হয়, তখন সে খুব স্বার্থপর হয়ে যায়; সে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবে—আর কারও প্রতি তার কোনো চিন্তা থাকে না। কিন্তু তার এই স্বার্থপরতার জন্য তো সমাজ দায়ী। আমরাই তাকে ছোটবেলা থেকে এটা শিখিয়ে এসেছি।
এখানে যত মা-বাবা আছেন, শিক্ষক আছেন ও তরুণেরা আছেন—ভবিষ্যতে যাঁরা মা-বাবা হবেন, প্রত্যেকের জন্য বলছি, আমি মন থেকে চাই, আমরা সবাই সন্তানকে কখনোই জিজ্ঞাসা করব না যে পরীক্ষায় সে কত নম্বর পেয়েছে। সন্তান যখন স্কুল থেকে আসবে, আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করব, সে আজকে কাকে কাকে সাহায্য করেছে, কার কার মুখে হাসি ফুটিয়েছে। এতে সন্তানের মনে ধারণা হবে যে পরীক্ষায় প্রথম হওয়াটা জরুরি নয়, জরুরি মানুষকে সাহায্য করা, তাদের মুখে হাসি এনে দেওয়া। এই সন্তানেরা যখন তরুণ হবে তখন আমাদের সমাজটাই বদলে যাবে। কারণ, তখন আমাদের সমাজে এমন এমন সব মানুষ থাকবেন, যাঁরা নিজের জন্য না, সমাজের সবার জন্য চিন্তা করবেন।
আমি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এই পরিবর্তনটা খুব তাড়াতাড়ি দেখতে চাই।

[আমির খানের জন্ম ১৪ মার্চ, ১৯৬৫ সালে, মুম্বাইয়ে। তিনি ২০০৩ সালে পদ্মশ্রী ও ২০১০ সালে পদ্মভূষণ পদকে ভূষিত হন। সমাজসচেতন এই অভিনয়শিল্পী তরুণদের মনোজগৎ নিয়ে কাজ করেছেন তারে জামিন পার ও থ্রি ইডিয়টস সিনেমায়। এ ছাড়া তাঁর ‘সত্যমেব জয়তে’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি ভারতে বিদ্যমান নানা সমস্যার চিত্র তুলে ধরছেন। অনুষ্ঠানটি নতুন আঙ্গিকে আবার প্রচারিত হতে যাচ্ছে। ]
সূত্র: ২০১২ সালের মাঝা পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য। ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: মনীষ দাশ

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account