দুইজন দয়ালু সেলসম্যান এবং একটি খারাপ মানুষ

রাস্তার মোড় ঘুরে আসার সময়ই ছেলেটি বৃদ্ধ লোকটিকে দেখতে পায়। আলো ঝলমলে মিষ্টির দোকানের ভেতর পরিপাটি করে সাজানো খাবারের দিকে তাকিয়ে আছেন বৃদ্ধ। গায়ের মলিন পোষাক দেখে বেশ বোঝাই যাচ্ছে তিনি এই দোকানের কাস্টমার নন। বৃদ্ধকে অতিক্রম করে আরো কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরে ছেলেটি ভাবলো, আহারে বেচারা! মিষ্টির দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে অথচ ভেতরে ঢুকে কিনে খাবার সাধ্য নেই। খারাপ লাগারই কথা। ছেলেটি কি যেন চিন্তা করে ঘুরে দাঁড়াল। লোকটাকে একটা মিষ্টি কিনে দিলে কেমন হয়? বৃদ্ধ মানুষটি খুশিই হবে।

ছেলেটি দোকানের সামনে ফিরে এসেছে। ততক্ষণে দোকানের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন একজন সেলসম্যান। হাতের মোড়কে সাজানো দুটি মিষ্টি তুলে দিয়েছেন বৃদ্ধের হাতে। বৃদ্ধ এবং সেলসম্যান, দু’জনের মুখেই তখন পরম আনন্দের হাসি।


এই মানুষটা চা বিক্রি করেন। মতিঝিলের এই এলাকায় তিনি ছোট একটা চায়ের দোকান চালান দীর্ঘ দিন ধরে। কাজের ফাঁকে দুপুরে দোকানের ভেতরই খেয়ে নেন। খাবার সময় একটা ব্যাপার তিনি অনেক দিন ধরেই লক্ষ্য করছেন। তার আশে-পাশে বেশ কিছু বসার বেঞ্চ আছে। দুপুরে খাবার সময়টায় সেখানে কিছু রিক্সাওয়ালা এবং ভিক্ষুক বসে থাকে। বসে বসে যে কাঠ ফাটা দুপুরের রোদে জিরিয়ে নেয় ব্যাপারটা আসলে এমন না। এই সময়টায় তাদের খাবার কিছু থাকেনা বলেই বেঞ্চে বসে থাকে। কখন হয়ত এক-দু টুকরো বিস্কুট বা এক কাপ চা দিয়ে দুপুরে খাবারের কাজ চালায়।

চা-বিক্রেতা দেখলেন, এই লোকগুলো তার থেকেও অসহায়। এদের জন্য কিছু করা দরকার। কিন্তু তার সাধ্যের মধ্যে কি করতে পারেন? ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি বের করলেন। বাজার থেকে চাল, ডাল কিনে এনে খিচুড়ি রান্না করলেন। দুপুরে যে মানুষগুলো তার চারপাশে উপোস হয়ে বসে থাকে, তাদের খাওয়ালেন। এরপর থেকে এ কাজটা তিনি প্রায় সময়ই করেন। অভুক্ত মানুষগুলোকে খাওয়ান। কতটুকু সাধ্য তার? খুবই অল্প। হয়ত আমরা যারা এই লেখাটা পড়ছি তাদের থেকেও অনেক অনেক অল্প। কিন্তু দেখুন, বিশাল এক সাগরের সমান হৃদয় এই সেলসম্যানের।


দ্বিতীয় গল্পটা ‘একজন খারাপ’ মানুষের। উপরের গল্প থেকে প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন।


একজন মানুষ যখন রাজনৈতিক ক্ষমতা, চাঁদাবাজি, দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা উপার্জন করে, তখন তো সেই টাকার কিছু খরচ করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দেয়াই যায়। নিজের পড়াশোনার দৌড় যাই হোক না কেন, একাধিক হজ্ব করে নামের আগে ‘আলহাজ্ব’, নিজের নামে স্কুল-কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি বা ট্রাস্টি বোর্ডের ডিরেক্টর উপাধি লাগালে কে মানা করবে? ‘সব সম্ভবের দেশে’ এমন লোকের সংখ্যা একেবারে কম নয়।

এই লোকগুলোর একটা বড় সমস্যা আছে। তাদের অধীন্তদের তারা মনে করে চাকর। এখন এই অধীনস্তদের মধ্যে থাকতে পারে প্রবীণ শিক্ষক, ডক্টরেট ডিগ্রিধারী, বছরের পর বছর জ্ঞানের সাধনা করা প্রফেসর অথবা মাত্র জয়েন করা তরুণ মেধাবী শিক্ষক।

আমি যে গল্পটা বলছি সেটা এক তরুণ মেধাবী শিক্ষককে নিয়ে। দেশের অত্যন্ত প্রেস্টিজিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল গ্রেড নিয়ে পাশ করে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে সে। তো এই শিক্ষক ইদানিং ইসলামের কিছু বিষয় প্র্যাকটিস করার চেষ্টা করছেন। ব্যাপারটা একেবারেই ব্যাক্তিগত এবং সাধারন পর্যায়ের।

অপর দিকে তার নিয়োগকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক জনাব ‘আলহাজ্ব’ সাহেব সেকুল্যার রাজনীতির সাথে জড়িত। এদেশের সেকুল্যার রাজনীতি এক বিরাট আজব বস্তু। যাক সে কথা।

তো, সেই তরুণ শিক্ষকের আগ্রহ হল ধর্ম আর সেক্যুলার রাজনীতির সাথে জড়িত ‘আলহাজ্ব’ সাহেবের সমস্যাও হল ধর্ম। সমস্যা মানে হল ধর্ম হতে হবে ‘আলহাজ্ব’ সাহেবদের আদর্শের মানদন্ডে বিবেচিত। মাঝে মাঝে মসজিদে যাওয়া, দুই ঈদে নামায পড়া, কেউ মারা গেলে কুলখানীতে অংশগ্রহন করা আর বৃদ্ধ বয়সে দাঁড়ি-টুপি পরে দুই তিনবার হজ্ব করা। এইতো ধর্ম। একজন তরুণ শিক্ষক কেন টাকনুর উপরে প্যান্ট পরবে? কেন দাঁড়ি রাখবে, পাঞ্জাবি পরে ক্লাস নেবে? এসব করতে হবে কে বলেছে? এসব এক্ট্রিমিজমের লক্ষণ!! তরুণ বয়সে এসব করতে হবে কোথায় লেখা আছে? কোথায়? কোথায়?? কোথায়???

বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকের সাথে তর্ক করাটা উচিত না। সুতরাং, তিনি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর এই তরুণ শিক্ষককে বললেন, “আপনি যে টাকনুর উপরে প্যান্ট পরেছেন এটা কুরআনের কোন আয়াতে আছে? আছে কোন হাদীসে? আমাকে বলেন কোথায় আছে। কোথাও নাই। নামান প্যান্ট। এক্ষুনি নামান” তখন বেচারা উত্তরে কিছু না বলে চুপ করে প্যান্টটা নামিয়ে নিয়েছিল। তাকে তিনি সূরা ইয়াসিনের ১০ আয়াত শোনাতে বলেন, অমুক আয়াতের অর্থ বলতে বলেন, তমুক জিনিস সম্পর্কে কুরআনে কি আছে জানতে চান। একাধিক সাঙ্গ-পাঙ্গ ঘেরা ট্রাস্টি বোর্ডের সম্মানিত সভাপতি দীর্ঘ সময় ধরে তার পাশের চেয়ারে বসিয়ে শিক্ষককে এভাবে অপমান করতে থাকেন। অপমানের ভাষা অত্যন্ত নিচু এবং জঘন্য। অন্যান্য শিক্ষকরাও তাদের আমল অনুযায়ী এভাবে নসিহত আর তবারক পেয়েছেন তার কাছ থেকে। চল্লিশ- পয়তাল্লিশ মিনিট একাধারে বয়ান করে রুম থেকে বের হন তিনি। বের হয়েই ঘুরে দাঁড়ান। নাহ, এই কম বয়েসি লেকচারার কেন এভাবে ধর্ম প্র্যাকটিস করবে? তাও তার বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘আলহাজ্বের’ মনের রাগ কমেনি। আবার সেই শিক্ষককে কয়েক দফা কথা শোনালেন। উপস্থিত অন্যান্য শিক্ষক এবং ছাত্রদের সামনেই।

উপরের গল্পগুলো সত্য। আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, একজন মৌলবাদী শিক্ষককে (আমি প্র্যাকটিসিং বলে অভ্যস্ত) এভাবে অপমান করাতে কি এমন সমস্যা হলো? নারে ভাই। কারো ব্যক্তিগত ‘স্বাধীন’ ধর্ম চর্চার অধিকারে আঘাত করা হয়ত এমন কোন বড় ঘটনা না। কিন্তু তিনি অন্যান্য সম্মানিত শিক্ষকগণের সাথে যে ব্যবহার করেছেন সেটা গ্রহনযোগ্য নয়। তেমনি গ্রহনযোগ্য নয় তার অবৈধভাবে আয় করা হাজার কোটি টাকার অহংকার। এসব টাকায় তিনি শিক্ষালয় গড়েছেন। মানব সেবার জন্য? জ্ঞান বিতরণের জন্য? নাকি নিজের সুনাম বৃদ্ধি এবং লাখ-কোটি কাল টাকা চাপা দেবার জন্য?

দয়ালু সেলসম্যান এবং খারাপ মানুষের গল্প একসাথে বলার একটা কারণ আছে।

ধরে নেই, জনাব ‘আলহাজ্বের’ গড়া শিক্ষালয়গুলোর প্রবেশমুখে লেখা আছে, “শিক্ষার জন্য এসো, সেবার জন্য বেরিয়ে যাও”। সত্যি, এমন অসংখ্যা তথাকথিত ‘আলহাজ্বদের’ পরিচালিত শিক্ষালয়গুলো থেকে বের হওয়া সার্টিফিকেটধারীদের বদান্যতায় দেশে মানব সেবার বন্যা বয়ে যাচ্ছে।

আমি শুধু ভাবি, এভাবে বছরের পর বছর যারা মানব সেবার পাঠ নিয়ে বের হচ্ছে- তাদের সাথে বিদ্যালয়ের আঙ্গিনা পাড়ানোর সুযোগ না পাওয়া আমাদের এই দুই দয়ালু, অশিক্ষিত সেলসম্যানের এতো পার্থক্য কেন? আছেন কোন ভাই, এই প্রশ্নের জবাব দেবেন?

Special thanks to Ahmed Shamim Hasan Shaon 

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account