পূঁথি পাঠের আসর

সন্দীপনের উৎসবের ব্রুশিয়র থেকে-

"আমাদের চিরায়ত লোক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো পূঁথি পাঠ। পূঁথি আমাদের গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐহিত্যকে ধারণ করে। এক সময়ের জনপ্রিয় পূঁথি পাঠ আজ নগর সংস্কৃতির প্রবল জোয়ারে বিলুপ্তের পথে। অথচ এই পূঁথি এক সময়ে ছিলো গ্রাম্য বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।

সময়ের পরিক্রমায় আমরা ইতিহাস ভুলে যাই। আমাদের নিজেদের শেঁকড় থেকে ধীরে ধীরে সরে যাই সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে। আমাদের প্রয়োজন ইতিহাস চর্চার। ইতিহাস চর্চার ও তার উপস্থাপনের প্রয়োজনীতাকে বিবেচনা করেই এই ‘পূঁথি পাঠের আসর’ নামক নাটকের রচনা। নাটকের গতানুগতিক ধারার বাহিরে গিয়ে আমাদের শত বছরের ঐহিত্য পূঁথি পাঠকে কেন্দ্র করেই এই নাটকের ঘটনা প্রবাহ। এর উপাদান নেয়া হয়েছে ইতিহাস থেকে। প্রতিটি চরিত্র ঐতিহাসিক। সংলাপ এবং পূঁথি পাঠের সম্মিলনে ইতিহাস যেনো জীবন্ত হয়ে ওঠে চোখের সামনে।

গ্রাম্য বৃদ্ধ পূঁথি পাঠক তার শ্রোতাদের এই বাংলা স্বাধীন হবার গল্প শোনান পূঁথি র মাধ্যমে। তার গল্পের শুরু হয় বৃটিশদের বাণিজ্য তরী নিয়ে এই সবুজ, শ্যামলা, সৃমদ্ধশালী বাংলায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্য নিয়ে আগমনের মাধ্যমে। ধীরে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ভে তাদের ষড়যন্ত্র, তার পরাজয়, বৃটিশদের ক্ষমতা দখলের চিত্র ফুটে ওঠে তার পূঁথিতে। এরপর শরীয়তুল্লাহ, তীতুমীরদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং অবশেষে বৃটিশদের দ্বারা দেশভাগের গল্প শোনায় সে। ধীরে ধীরে তা পরিণতি পায় পাকিস্থানের শাসকদের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনমানুষের ক্ষোভ, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের নির্বাচন এবং সবশেষে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে।

‘পূঁথি পাঠের আসর’ সন্দীপন থিয়েটারের একটি পরীক্ষামূলক প্রযোজনা। রচনা করেছেন আহমেদ শামীম হাসান এবং আহমেদ ইসমাঈল হোসেন। ২০০৯ সালে মির্জা শাখেছেপ সাকিব এর নির্দেশনায় এর প্রথম মঞ্চায়ন হয়। এটি দ্বিতীয় মঞ্চায়ন। এবারে নির্দেশনায় রয়েছেন আহমেদ ইসমাঈল হোসেন।"


এবার নিজে কিছু বলি। সন্দীপন থিয়েটারের নাট্যবিভাগের ছেলেগুলো বয়সে একেবারেই তরুণ। এদের মধ্যে কেউ স্কুলের ছাত্র, কেউ কলেজের। বাকিরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাস্ট ইয়ার কি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। এদের নিয়ে ‘পুঁথি পাঠের আসর’র মতো প্রযোজনা দাঁড় করানো ছিলো বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। তাও হাতে সময় ছিলো মাত্র পনেরো দিন। জ্বি, পনেরো দিন এবং এই ক’দিনেই ওরা পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা মঞ্চে প্রর্দশন করেছে।

অভিনয় দক্ষতা আর ডেডিকেশন দুই জিনিস। এই ছেলেগুলোর মাঝে অভিনয় দক্ষতা কম ছিলো। কিন্তু ডেডিকেশন ছিলো পাহাড় সম। শুধু করার জন্য করা নয়, সত্যি সত্যিই ওরা নাটকটির জন্য মেধা, শ্রম, যোগ্যতা সব কিছু ঢেলে দিয়েছে। ওদের রিহার্সেল দেখে ধারণা করা কঠিন ছিলো যে ওরা মঞ্চে খুব চমৎকারভাবে নাটকটিকে দাঁড় করাতে পারবে। আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই করেছে ওরা।

একসময়ে আমরা সন্দীপনে লিটল থিয়েটার পরিচালনা করতাম। বেশ চমৎকার একটা গ্রুপ ছিলো। ওদের নিয়ে আমরা পুরো একটা নাটকও মঞ্চে প্রদর্শন করেছি। সেই গ্রুপ থেকে জাওয়াদ আমীন, তালহা মোস্তফা, ফিরোজ মেহেদি, টিপুসহ বেশ ক’জন এখন বড়দের এই গ্রুপটাতে কাজ করছে। এদের সাথে কাজ করার সবচেয়ে বড় সুবিধে হলো, এরা আমাদের কাজের ধরণের সাথে পরিচিত। নতুনরা জড়তা কাটাতে এবং নির্দেশকের স্টাইলের সাথে পরিচিত হতে প্রচুর সময় নেয়। লিটর থিয়েটারের এদের জন্য সুবিধে ছিলো এদের এমন কোন সমস্যায় পড়তে হয়নি।

‘পূঁথি পাঠের আসর’এর মূল আইডিয়াটা শাওনের। আমাদের মতো শহরে বেড়ে ওঠা প্রজন্মের কাছে পূথিঁ পাঠ পুরোপুরি অচেনা বস্তু। বড়রাও খুব ভালো করে এ সম্পকে জানে না। গ্রামের যারা বড় হয়েছেন মানে বয়সে যারা একটু প্রবীণ, তারা পূঁথির সাথে বেশ পরিচিত। অনেককে দেখেছি এখনো পূথিঁকে খুব মিস করে। আমাদের ধারণাটা ছিলো গতানুগতিক ধারার বাহিরে গিয়ে কিছু করা। এক্ষেত্রে পূঁথির আইডিয়াটা বেশ কাজের ছিলো। কিন্তু শুধু পূঁথি পাঠ দিয়ে তো পুরো একটা প্রযোজনা দাঁড় করানো সম্ভব না। তখন পূঁথি পাঠের সাথে অভিনয়ের বিষয়টাও চলে এলো। এক পাশে বৃদ্ধ মতোন একজন পূঁথি পাঠ করবে। তার সামনে লোকজন বসে বসে পূঁথি শুনবে। আর তার পাশেই পূঁথির গল্পগুলো দৃশ্যায়ন হতে থাকবে। যারা অভিনয় করবেন, তাদের সবার এক রকমের পোষাক। গল্পের প্রয়োজনে একেক সময় একেকজন ভিন্ন্ ভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করবেন। চরিত্রের বৈচিত্র্যতা বোঝাতে সেখানে ব্যবহার হয়েছে ভিন্ন রঙ্গের ওড়না। সেই সাথে বাঁশ এবং বেতের ব্যবহার হবে বিভিন্ন পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য। পূঁথি প্রায় পুরো স্ক্রিপ্টটা শাওনের করা। আমি সংলাপের কিছু কাজ করেছি। প্রযোজনার নাম নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ থাকলেও শেষ পর্যন্ত মনে হলো পূঁথিই যেহেতু আমাদের মূল বিষয়, তাই ‘পূঁথি পাঠের আসর’ নামটাই বেশ ভালোভাবে এরসাথে মানিয়ে যায়।

আমরা এর প্রথম মঞ্চায়ন করেছিলাম রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অডিটোরিয়ামে। সে সময় সাকিব ভাই এর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। পূঁথি পাঠ করেছিলো রাজু। ওরা পূঁথি পাঠ এতোটাই চমৎকার ছিলো যে এবার সাত বছর পর দ্বিতীয় মঞ্চায়নের সময়ও অনেকে জানতে চেয়েছিলো এবারও রাজু পূঁথি পড়বে কিনা। যাই হোক, এবারের মঞ্চায়নে পূঁথি পড়েছে শিল্পী আবদুল্লাহ আল মাসুদ। বেশ ভালোই করেছে ও।

নিদের্শনার কাজে সন্দীপনের পরিচালক থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান পর্যন্ত সবাই যথেষ্ঠ সহযোগীতা করেছেন। বিশেষ করে এবারো সাকিব ভাই, শাওন, আবু সালেহ, হাসান আবদুল্লাহ যথেষ্ঠ সময় দিয়েছে।

নাটকের মান দন্ডে এই প্রযোজনা কতটা উতরে যাবে বলা কঠিন। কিন্তু নাটক ও দর্শকের চাহিদার বিচারে নি:সন্দেহে আমরা কিছু একটা করার চেষ্ঠা করেছি। ঠুনকো মঞ্চ মাতানো প্রদর্শনীর পরিবর্তে আমরা দর্শককে পরিশীলিত, পরিকল্পিত কিছু দিতে চেয়েছি। কতটা সফল হয়েছি? এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা আরো অনেক দূর যেতে চাই। ওই যে বল্লাম, অভিনয়ের যোগ্যতা হয়তো কম। কিন্তু লক্ষ্যে পৌছানোর আকাঙ্খাই আমাদের কখনো থামতে দেবে না।

Comments

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account