রাতের আকাশ


রাতের আকাশের দিকে তাকালে খুব সহজেই সপ্তর্ষিমন্ডল দেখা যাবার কথা। কিন্তু 'কথা' হলেইতো তা আর বাস্ব হয়ে যায় না। হবে কি করে? ধূলো, বালি, ধোঁয়াতে ঢেকে থাকে শহরের আকাশ। আপনি ইচ্ছা করলে এটাকে অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা বলতে পারেন। এটা আমরাই প্রতিদিন একটু একটু করে তৈরী করছি। এই অদৃশ্য দেয়াল আমাদের প্রতিরাতে আকাশের অপূর্ব দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত করছে। সত্যি বলছি। অপূর্ব সে দৃশ্য। একবার তাকালে চোখ ফেরানো কঠিন। আপনি শহর থেকে আকাশের দিকে তাকালে গুটি কয়েক তারা দেখতে পাবেন। কিন্তু গ্রামে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে হাজার হাজার বিজলি বাতির ঝলকানি নেই, নেই ধূলা-বালি, ধোঁয়ার ঝঞ্ঝাট। আকাশ একদম পরিস্কার। উন্মুক্ত। একবার চোখ মেলে তাকালে আপনার দৃষ্টি আপনাকে নিয়ে যাবে এক রুপকথার রাজ্যে। মনে হবে মাথার উপরে এক বিশাল কালো গম্বুজে ঢেকে আছে পুরো পৃথিবী। আর তার বুকে লাখো লাখো ঝলমলে অপূর্ব তারার আসর। তারারা যেনো হাট বসিয়েছে। কোনো কমতি নেই সে হাটে। আপনি অবশ্যই বিস্ময়ে অভিভূত হবেন। প্রতিরাতে। যখনি তাকাবেন রাতের উন্মুক্ত আকাশের দিকে। শীতকালে কিন্তু আকাশ অনেক পরিস্কার থাকে। টুকরো টুকরো মেঘের খন্ড আকাশে ভেসে বেড়ায় না। বাতাসে জলীয় বাস্পও থাকে তুলনামূলক কম। ফলে বাতাস থাকে স্বচ্ছ। কেউ যদি রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে চায় তবে শীতকালটাই বেশি উপযুক্ত। প্রক্মিমা সেন্টুরাই, সেন্টুরাই, সাইরিয়াস, লুইটেন - কত সহস্র তারা। তারা শব্দটা কিন্তু ইংরেজি। এসেছে গ্রীক শব্দ অ্যাস্টার হতে যার উৎপত্তি হয়েছে আবার হিত্তীয় ভাষার শিত্তার শব্দ থেকে। এই শিত্তার এসেছে সংস্কৃত শব্দ সিতারা হতে। হাতে অখন্ড অবসর থাকলে আপনি চাইলে তারাগুলো গুনে দেখতে পারেন। খুব বেশি নয়। মাত্র দশ হাজার কোটি তারা রয়েছে মিল্কিওয়ে নামক আমাদের এই গ্যালাক্সিতে। যতবার তাকাবেন ততবারই অনন্য মনে হবে সে দৃশ্য। মনে হবে আকাশটাকে ছুঁয়ে দেখি। কি হবে যদি যেতে পারতাম ঐ দৃশ্যমান রুপকথার রাজ্যে? কি আছে ওখানে? এমনি কত ভাবনা কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও আপনাকে আচ্ছন্ন করবে। আর এসব ভাবার জন্য আপনাকে বিজ্ঞানী হতে হবে না। এ হলো মানব মনের এক আদিম তাড়না। শত সহস্র বছর ধরে যতবারই তারা ঝলমল ঐ আকাশের দিকে তাকিয়েছে মানব সন্তান ততবারই তার মস্তিস্কের নিউরনে আলোড়ন তুলেছে এমনি শত ভাবনা। সম্ভবত প্রথম মানব যখন তার প্রথম রজনীতে প্রথমবারের মত চোখ মেলে চেয়েছিল রাতের আকাশে, ঠিক তখনি এক অবাক বিস্ময়ে সে আবিভূত হয়েছিল। সে বুঝতে শিখেছিল এই অনন্ত মহাবিশ্বের সামনে সে নিতান্তই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ এক সৃষ্টি। আর মহান, বৃহৎ হলো সেই স্রষ্টা যিনি তৈরী করেছেন এসব। সম্ভবত তাঁর ইচ্ছাতেই মানুষের জীনের মধ্যে এই তাড়না অঙ্গীভুত হয়ে গেলো। ফলে মানুষ যখনি ঐ বিশাল সৃষ্টির মুখামুখি হয় তখনি সে খুঁজতে থাকে এই বিশাল সৃষ্টির স্রষ্টাকে। খুঁজে ফেরে তার নিদর্শন। আসলে অজানাকে জানবার এই তাড়না মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিই তাকে দিয়েছে সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে মর্যাদার আসন। সাহায্য করেছে বর্তমান আধুনিক সভ্যতা গড়ে তুলতে। এই প্রবৃত্তিই মানুষকে দিয়েছে চন্দ্র বিজয়ের স্বাদ, দিয়েছে সহস্র আলোকবর্ষব্যাপি ছড়িয়ে দিতে অনুসন্ধানী দৃষ্টি, আর দিয়েছে মহাকাশে মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের স্বপ্ন। আজ যে মানব শিশু আকাশের দিকে তাকিয়ে বহুদূরের ঐ তারাগুলোকে ধরতে চায়, সেই হয়তো বড় হয়ে স্বপ্ন দেখবে ঐ তারাগুলোতে মানুষের কলোনি বিস্তারের। দৃশ্যমান যে তারা ঝলমল রাতের আকাশ মানুষ আজ উপভোগ করছে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে, হয়তো ভবিষ্যতে সুদূর কোন এক গ্যালাক্সির কোন এক স্থান থেকে তেমনিভাবে চেয়ে থাকবে রাতের আকাশের দিকে। কেউ হয়তো আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলবে, ঐ দেখো, আমাদের আদি বাসস্থান পৃথিবী। আমরা যখন রাতে কোন সুন্দর মিটমিট করা তারাকে দেখতে পেয়ে উল্লসিত হই, তারাও হয়তো তখন তেমনি উল্লসিত হবে। উপভোগ করবে রাতের আকাশ। সত্যি কি উপভোগ করত পারবে? সত্যি কি তারা দেখতে পাবে পৃথিবীকে? নাকি এখনকার মত ধোঁয়া, গ্যাস তাদের দৃষ্টিকে আড়াল করবে? বঞ্চিত করবে তাদের রাতের আকাশের সে অনুপম দৃশ্য উপভোগ করা থেকে? হয়তো করবে, হয়তো করবে না।

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের নীরবতা

রক্ত পরীক্ষা (Blood test) এর অর্থ বুঝুন

Nostro, Vostro এবং Loro account